আত্মরক্ষায় নারীর সক্ষমতা জরুরি

Attackড. সীনা আক্তার: পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে একদল ইতর পুরুষ কয়েকজন নারীর ওপর যৌন হয়রানি চালায়। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এই কুৎসিত ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া বিশেষ জরুরি মনে করি।

প্রায় শান্তিপূর্ণভাবেই সারাদেশে এই বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য উৎসব পালিত হয়েছে। কিন্তু এই যৌন হয়রানির ঘটনাটি যেন সেই উচ্ছ্বাসের মধ্যে এক বিন্দু কালিমা। শোনা যাচ্ছে ৩০-৩৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল বর্ষবরণ উৎসবে যৌন-হয়রানির ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তার মানে, বর্ষবরণে অংশগ্রহণকারী বাকি হাজার-হাজার পুরুষ সভ্য, সংবেদনশীল এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটা স্বস্তির ও সুখকর। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই যৌন-নিপীড়কদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সন্তুষ্ট হতাম। আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতাম, যদি হয়রানির শিকার মেয়েরা নিজেরাই প্রতিরোধ তৈরি করে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হতো। আমি নিশ্চিত ভুক্তভোগী মেয়েদের একজন যদি সাহস এবং শক্তি দিয়ে ওই নোংরা পুরুষের একজনের নাক বরাবর ঘুষি বা লাথি দিতে পারত, তাহলে অন্য মেয়েরা তার দেখাদেখি একই কাজ করত এবং আশেপাশের সহানুভূতিশীল পুরুষরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মেয়েদের সঙ্গে যোগ দিত। আমি বিশ্বাস করি ঠিক এভাবেই নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব।

”আমি নিশ্চিত ভুক্তভোগী মেয়েদের একজন যদি সাহস এবং শক্তি দিয়ে ওই নোংরা পুরুষের একজনের নাক বরাবর ঘুষি বা লাথি দিতে পারত, তাহলে অন্য মেয়েরা তার দেখাদেখি একই কাজ করত এবং আশেপাশের সহানুভূতিশীল পুরুষরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মেয়েদের সঙ্গে যোগ দিত।…নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারীর শারীরিক সক্ষমতা। অথচ, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রথমত প্রতিরোধ তৈরি করতে অথবা দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে যে শারীরিক সক্ষমতা এবং কৌশল জানা থাকা দরকার, তা আমাদের দেশের নারীদের নেই। এমনকি অধিকাংশ নারীর দৌড়ানোর দক্ষতা পর্যন্ত নেই। …”

প্রসঙ্গক্রমে, অনেকদিন থেকে ফেসবুকে নারীর নিরাপত্তা বিষয়ক একটা ভিডিও দেখছি। আমার পরিচিত অনেকে ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। যাদের মধ্যে অনেকেই আবার নারীর অধিকার বিষয়ে সোচ্চার। সেই ভিডিওতে দেখা যায় একটা অল্পবয়সী শিক্ষার্থী বই হাতে একা হেঁটে যাচ্ছে, দু’জন ছেলে অসৎ-উদ্দেশ্যে মেয়েটির পিছু নেয়। কিন্তু মেয়েটিকে রক্ষা করার জন্য আশেপাশের কয়েকজন সংবেদনশীল ছেলে চারিদিকে এক বৃত্ত তৈরি করে। এতে খারাপ ছেলেগুলোর উদ্দেশ্য বিফল হয়।

এই ভিডিওর বার্তাটি হচ্ছে, যদি কোনও মেয়ে নিপীড়নের শিকার হয় বা তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে ভালো ছেলেদের দায়িত্ব তাকে রক্ষা করা। নিঃসন্দেহে ভালো একটা উদ্দেশ্যই এই ভিডিওটা বানানো হয়েছে, কিন্তু আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কারণ, গৎবাঁধা চিন্তার অধিকারীরাই কেবল নারীর চারিদিকে বৃত্ত দিয়ে বা দেয়াল দিয়ে, ঘরে বন্দি করে, তথাকথিত পর্দা দিয়ে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন।

বলাই বাহুল্য, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নারীর স্বাধীনতা হরণের রাজনীতি। এই রাজনীতির খেলা চলমান এবং সেজন্য নারীকেই সজাগ থাকতে হবে, যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীকে রাজনীতির গুটি বানাতে না পারে।

ইহা ওমুকে করছে, ইহা তমুকের ওপর আঘাত… এই ধরনের হাবিজাবি কথা বলে মূল বিষয়কে আড়াল করার প্রবণতা মানে দণ্ডনীয় অপরাধকে লঘু করা। যা বারবার অন্যায় ঘটনা ঘটাতে সাহায্য করে। মনে হচ্ছে, নববর্ষের ঘটনাটিকে সেভাবেই প্রভাবিত করা হচ্ছে। সহজ-সরল বিষয় হচ্ছে, একদল যৌন-নিপীড়ক ঘটনাটি ঘটিয়েছে যা দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এর যথাযথ শাস্তি হতে হবে।

জনসমক্ষে বিশেষ করে কোনও উৎসব-পার্বণে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। পাশাপাশি, যেকোনও পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বিষয়ে সজাগ থাকা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ব্যক্তির নিজের।

কথায় বলে, নিজেকে সাহায্য করা সর্বত্তোমপন্থা (Self help is the best help)। নারী, নারী উন্নয়ন-অধিকার নিয়ে যারা সোচ্চার, তারা এই আলোকেই তৎপর হলে সফলতা আসবে মনে করি। আত্মরক্ষা নিশ্চিত করতে নারীর প্রয়োজনীয় সচেতনতা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে যথেষ্ট সক্ষমতা থাকতে হবে। আর এই সচেতনতা এবং সক্ষমতা তৈরি করার দায়িত্ব পরিবার, স্কুল, সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ এবং বেসরকারি সংগঠনগুলো।

নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারীর শারীরিক সক্ষমতা। অথচ, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রথমত প্রতিরোধ তৈরি করতে অথবা দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে যে শারীরিক সক্ষমতা এবং কৌশল জানা থাকা দরকার, তা আমাদের দেশের নারীদের নেই। এমনকি অধিকাংশ নারীর দৌড়ানোর দক্ষতা পর্যন্ত নেই।

তাই শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে শারীরিক সক্ষমতা উন্নয়ন এবং আত্মরক্ষামূলক বিষয় বাধ্যতামূলক করা জরুরি। এ সবই আত্মবিশ্বাস উন্নয়নে সহায়ক।

অন্যদিকে মেয়েদের স্কুল এবং পরিবার থেকে যৌন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরশীলভাবে অবস্থান নিতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে মেয়েদের পরোক্ষভাবে এসবে নিরুৎসাহিত করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রায়ই দেখা যায় নিরাপত্তার নামে মেয়েদের সার্বক্ষণিক অতি-নিরাপত্তা এবং অতি রক্ষণশীল বলয়ের মধ্যে থাকতে হয়।

Sina Akhter
সীনা আক্তার

পরিবার থেকে মেয়েদের সাধারণত বাড়ির বাইরের কোনও কাজে পাঠানো হয় না। এই অতি নিরাপত্তায় (Over protection) মেয়েরা যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না। ফলে অনেক বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শিখতে পারে না। বাড়ির বাইরে হয়ত নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে, কিন্তু তা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে বিষয়ে ধারণা থাকা এবং প্রস্তুত থাকাটা বেশি জরুরি। এক্ষেত্রে সুবিধাজনক হাতিয়ার যেমন ছোটলাঠি, কাঁটা চামচ, মরিচ গুড়ো-ঝাঁঝালো স্প্রে সঙ্গে রাখা এবং প্রয়োজনে তা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যবহার করা।

যৌন-নিপীড়ন, সহিংসতারোধে সমন্বিত কর্মসূচি এবং তৎপরতা অত্যাবশ্যক, ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে। নববর্ষসহ সকল উৎসব উদযাপন চলবে, যেখানে থাকবে নারীর বর্ণিল উপস্থিতি, আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস। সেখানে থাকতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে নারীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ পরিবেশ। উৎসব শেষে মিডিয়ায় থাকবে সচিত্র আনন্দময় উৎসবের সংবাদ।

দুর্ভাগ্যক্রমে কোনও মেয়ে যৌন হয়রানির মুখোমুখি হলে মেয়েরা নিজেরাই সে পরিস্থিতি প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে সক্ষম হবে। অন্তত চেষ্টা করবে। মিডিয়ায় সেই সংবাদ দেখতে চাই।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.