প্রয়োজন নারী-পুরুষের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ

Enoughরিয়াজুল হক: বাংলা নববর্ষের প্রথমদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কতিপয় পুরুষ নিপীড়ক নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন করেছে। ওই দিন পাবলিক পরিসরে নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটেনি। দেশের অনেক স্থানেই সংঘটিত হয়েছে।

বাগেরহাটে এক নারীর ওপর এমন যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার ভাই নিপীড়ক যুব পুরুষদের দ্বারা ছুরিকাঘাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য তেমন কোনো প্রতিবাদ বাগেরহাটে বা দেশের অন্য কোনো স্থানে হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীর ওপর সংঘটিত যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলনও চলছে। যেকোনো নিপীড়নের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ন্যায্য এবং সকল নাগরিকের তা কর্তব্য। একইসঙ্গে প্রয়োজন নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের কার্যকারণ ও প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের একাধিক ঘটনার কার্যকারণ হিসেবে গণমাধ্যমে একাধিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে বিষয়টিকে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। অনেকে এ ঘটনাকে সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাব বলে দেখছেন। অনেকে এই ঘটনাকে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত বলে দেখছেন। অনেকে এ ঘটনাকে শাসকশ্রেণির সংকট বলে দেখছেন।

অনেকে একে পাবলিক পোপার্টির ওপর সরকারদলীয় দখলদারিত্বের একটি প্রকরণ হিসেবে দেখছেন। এদের সকলের আলোচনার প্রেক্ষিত রাষ্ট্র, সরকার, আইনের শাসন, সুশাসন এবং শ্রেণি। কিন্তু লিঙ্গ এ প্রেক্ষিতের আলোচনায় প্রায় অনুপস্থিত। অর্থাৎ শ্রেণির রাজনীতি-দর্শন দিয়ে লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়নের একটি প্রকরণ নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীর ওপর সংঘটিত যৌন নিপীড়ন কী বিচ্ছিন্ন ঘটনা? এটি কী শুধু উৎসবে-পার্বণে ঘটে? নাকি এটি বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় প্রতি মুহূর্ত-এ ঘটে? এটি কী শুধু ভিড়ের মধ্যে সংঘটিত হয়? নাকি ভিড় নেই এমন স্থানেও ঘটে? এটি কী শুধু পাবলিক পরিসরেই ঘটে? নাকি এটি প্রাইভেট পরিসরেও ঘটে?

প্রাপ্ত তথ্য বলে, বাংলাদেশে প্রতি তিনজন কিশোরীর মধ্যে একজন তার কৈশোরবেলায় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

বাংলাদেশের আইনমতে যৌন নিপীড়ন হলো, অবৈধভাবে যৌন কামনা চরিতার্থ করার জন্য কারো যৌনাঙ্গ বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করা। তাহলে আমাদের দেশে এক ভয়াবহ যৌন নিপীড়নমূলক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হয় মেয়েশিশু ও কিশোরীরা। জনপরিসরে চলাফেরা করেন, এমন নারীদের প্রায় ৮৫ ভাগ বলেছেন, তারা মার্কেট প্লেসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ছিল, কটূক্তি/বুলিং, যৌন ইঙ্গিত, অশ্লীল শব্দ/আওয়াজ ইত্যাদি। তাহলে মেয়ে তথা নারীর ওপর যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের পরিসর শুধু পাবলিক প্লেস নয়, শুধু বিশেষ উৎসব-পার্বণ-অনুষ্ঠান নয়।

নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত—এ ঘটে। এর কোনো সীমানা নেই। বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থলে, পরিবহনে, মার্কেটে, অনুষ্ঠানে—সর্বত্র নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হন। যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর কোনো বয়স নেই, শ্রেণি নেই, জাতিক বা ভাষিক পরিচিতি নেই, ধর্মীয় পরিচিতি নেই। শুধু একটি পরিচিতি সে নারী। শ্রেণি, জাতিক বা ভাষিক, বা ধর্মীয় পরিচিতি নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের মাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে কিন্তু এ পরিস্থিতি থেকে তাকে মুক্তি দেয় না। কারণ আমরা একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করছি।

এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর শ্রম, দক্ষতা, শরীর ও যৌনতাকে পুরুষের অধীন করে। সেইসঙ্গে অধীন করে নারীর পুরো সত্তাকে—তার জীবন-জীবিকাকে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর শরীর ও যৌনতা হয়ে ওঠে পুরুষের সম্ভোগের, নিপীড়নের ও বলপ্রয়োগের একান্ত ক্ষেত্র। একজন ব্যক্তি তথা মানুষ হিসেবে নারীর শরীর ও যৌনতা যে স্বাধীন ও স্বায়ত্ত্বশাসিত, এবং এটি যে ওই নারীর নিজস্ব ডোমেইন, পুরুষতন্ত্র তা কখনও স্বীকার করে না।

তাই নারী কীভাবে তার যৌনতাকে অবদমন করবেন, কীভাবে তার শরীরকে ঢাকবেন, নারী কী পোশাক কীভাবে পরিধান করবেন, কীভাবে সাজবেন, কীভাবে সে তার যৌনতাকে উপস্থাপন করবেন, নারী কোথায় যাবেন, কার সাথে যাবেন, কার সাথে মিশবেন—সেসব বিষয়ে পুরুষতন্ত্র নিরন্তর কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করে। সেইসব কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলতে নারীকে উদ্বুদ্ধ করে। সেইসঙ্গে আদর্শের আদল তৈরি করে বলা হয়, যে নারী এসব কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলেন—তিনি হলেন ‘ভাল’-‘পবিত্র’-‘সতী’-‘ধার্মিক’ নারী।

পুরষতন্ত্র নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা, মানবিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব—এসব বিষয়কে প্রান্তিক করে কেন্দ্রীয় করে তার শরীর ও য়ৌনতাকে। নারীকে প্রতীকায়িত করে পুরুষের ইচ্ছার অধীন ভোগের ও যৌনতার একটি নিরেট বস্তুরূপে। আর পুরুষকে সামাজিকভাবে গড়ে তোলে মানবিক মানুষের বদলে এক কামুক ও নিপীড়ক মানুষ হিসেবে। যে পুরুষ তার ক্ষমতা চর্চা বা বলপ্রয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে নারীর শরীর ও যৌনতায়। তাই পারস্পরিক ইচ্ছা-সম্মতি, শ্রদ্ধা এবং মানবিক সম্পর্কের বাইরে, পুরুষ তার যৌন আনন্দলাভে যেকোনো নারীর শরীরের ওপর হামলে পড়েন, নারীর শরীরের ওপর বলপ্রয়োগ করেন, নারীর যৌনাঙ্গে বা অন্য কানো অঙ্গে সহিংস আঘাত করেন।

পুরুষতন্ত্র এখানেই থেমে থাকে না। পুরুষতন্ত্র শুধু বিভিন্ন সামাজিক এজেন্টের মাধ্যমে সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া পুরুষের মধ্যে নারীর শরীর ও যৌনতাকে ভোগের এবং নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর দখলের ও বলপ্রয়োগের মনস্তত্ত্ব-মূল্যবোধ তৈরি করে না, উপরন্তু পুরুষতন্ত্র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতি দ্বারা এর যথার্থতা দেয় ও নিপীড়ন সহায়ক বা অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে। তাই নারীর ওপর সকল ধরনের সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটে সবসময় ও সর্বত্র। আসলে যৌন নিপীড়নকে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের সমস্যা-ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, আইনের শাসন না থাকা, শাসক শ্রেণির ব্যর্থতা ইত্যাদির ভেতরে কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোগত  শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনাকে আড়াল করা হবে। এ থেকে মুক্তি আসবে না।

বাংলা নববর্ষের প্রথমদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও দায়হীনতা একটি জরুরি বিষয়। এ বিষয়ে তাদের জবাবদিহিতা তৈরি করতেই হবে। সেইসঙ্গে নিপীড়কদের আটক করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাতে তাদের যে রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচিতি থাক না কেন। তা না হলে নিপীড়কসহ অন্যরা এক ধরনের উৎসাহ পাবে। এই ইস্যুতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এসব হলো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ।

কিন্তু নারীর ওপর সবস্থানে-সবসময় ঘটা যৌন হয়রানি-নিপীড়ন-সহিংসতা-ধর্ষণ থেকে প্রতিকার পেতে হলে, যে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীর শ্রম, দক্ষতা, শরীর ও যৌনতাকে পুরুষের অধীন করে; যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীর শারীরিক, মানসিক, আবেগীয়, জৈবিক এবং তার যৌনতায় আঘাত, সহিংস আচরণ, অবরোধ, নিপীড়ন করার পুরুষের মনস্তত্ত্ব-মূল্যবোধ তৈরি করে; পুরুষতন্ত্রের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও রীতিনীতি  নারীর শরীর ও যৌনতার ওপর পুরুষের নিপীড়নের যথার্থতা দেয় ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে; তাকে নিরন্তর, সংগঠিতভাবে ও নারী-পুরুষের সম্মিলনে চ্যালেঞ্জ জানানোও জরুরি কাজ।

মোহাম্মদ রিয়াজুল হক

[email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.