মহিলা পরিষদের জোরালো ভূমিকা কই?

Nari n Religionসালেহা ইয়াসমীন লাইলী: মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যখন বলছিলাম, ‘এ ঘটনা কোন শ্লীলতাহানী নয়, এটা ধর্ষণ। অপরাধী যে দলের, যে মতের হোক কোনভাবেই যেন ছাড় দেয়া না হয়—আমার পাশে দাঁড়ানো একজন আমার হাতে চাপ দিয়ে সংযত হতে বললেন। আমার বক্তব্য এলোমেলো হয়ে গেছে ততক্ষণে। যতটা না মনোযোগ হারানোর জন্য, তার চেয়ে বেশি কেন আমাকে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন ভাবনায়।

পরে তিনি বললেন, ‘আমরা এই ঘটনাকে বাড়াতে চাই না। তাই শব্দ ব্যবহারে সংযত হতে চাই। ধর্ষণ নয়, লাঞ্ছিত বলো। এমন কোন কথা বা শব্দ বলো না, যাতে মেয়েদের আরও অপমান হয়’। হতবাক হতে হলো নারী সংগঠনের কোন নেতার মুখে এমন কথা শুনে।

তবুও বললাম, প্রতিবাদগুলো আরো জোরালো না হলে তো প্রতিকার হচ্ছে না।

দিন দিন যেভাবে বাড়ছে যৌনসন্ত্রাস তাতে আপনাদের আরো দৃঢ়তার সাথে মাঠে নামতে হবে।

তিনি বললেন, আমরা এই তো মানববন্ধন করছি। এর চেয়ে আর কীইবা করার আছে?

বললাম, এটুকু মানববন্ধন থেকে কি লাভ হচ্ছে বলুন?

এবার জবাবে তিনি বললেন, কিছু না হোক, এই যে আমরা সবাই একত্রে হলাম কতদিন পর, কথা হলো, হাসাহাসি হলো, সেটাই লাভ। অন্ততঃ হাসাহাসি করে আয়ু তো বাড়ে!

বিস্ময়ে আমার চোখ তখন উপড়ে যাওয়ার উপক্রম। তার কিছু পরে খবর এলো উলিপুরের বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান দুই কিশোরী ধর্ষণের শিকার। তারা থানায় আছে। খবরটি আমি সেই নারী নেতাদের জানালে তারা বাজেট নাই এইসব কাজে মুভমেন্ট করার বলে জানায়।

গত দুইদিন ধরে আমি মানসিকভাবে প্রায় অস্থির ও বিক্ষুব্ধ ছিলাম বর্ষবরণ উদযাপন আয়োজনে মেয়েদের উপর এক পাল তরুণের দলবেঁধে হামলে পড়ার খবরে। তার ওপর ফেসবুকসহ ও চারদিকের চেনা তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষ সহকর্মী, বন্ধুদের নারীর পোশাক ও চলাফেরাকে দায়ী করে এই বর্বরতার বৈধ করার চেষ্টাতে বির্পযস্ত লাগছিল নিজেকে। সে সময় জেলার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করা সংগঠনগুলোর আচরণ আমাকে আরও বেশি হতাশ করে তুলেছিল।

আমি খেতে পারছিলাম না, ঘুমাতে পারছিলাম না। বার বার কিছু লিখতে চাচ্ছিলাম, লিখতেও পারছিলাম না। শুধু বিভিন্ন নিউজ সাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম। ক্রমে অস্থিরতা ও অসহায়ত্ব আমাকে পেয়ে বসছিল। পরদিন যখন জেলা মহিলা পরিষদের সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণে গিয়ে আলোচনা শুনছিলাম আমার মনে হচ্ছিল এই আয়োজন আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কেন তারা একটা সময়োপযোগী প্রতিবাদ করবে না এই ভেবে ফিরে এসেছিলাম সেখান থেকে।

কিন্তু অস্বস্তি ও অস্থিরতা আমিকে স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছিল না। আমি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখি, ‘‘জাতির বিবস্ত্রতার অপমান ও বিক্ষুব্ধতায় যখন পুড়ছে দেশ, তখন মহিলা পরিষদের মহিলাগণের পুতু পুতু প্রতিবাদ আর নিজেদের দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধির আয়োজন! মহিলাগণ শাড়ি পরা শিখুন দক্ষতার সাথে! সচেতনভাবে সেফটিপিন আটকান যেন খুলতে গিয়ে কারো হাতে বিঁধে না যায়। যুগে যুগে যে দ্রৌপদীদের বস্ত্র হরণ হয়ে আসছে, হবে”।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্যে মেয়েদের উপর হামলে পড়ে তাদের কাপড় খুলে ফেলে উল্লাস করার খবরে যতটা না নাড়া দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি অপমানবোধে ফুঁসে উঠল নারী অধিকারের অভিভাবক এই প্রগতিশীলরা! তারা ফেসবুকে মন্তব্য করে, ফোন দিয়ে, জনে জনে বিচার চেয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেল।

তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, নইলে তারা আমার মহিলা পরিষদের সদস্যপদ বাতিল করে দেবে! দাদাভাইরা আমাকে ফোন দিয়ে পানিতে থেকে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের শিক্ষা দিতে এলো। সামাজিকভাবে বয়কটের হুমকিও বাদ গেল না তাতে।
ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় ও অর্থ  তাদের না থাকলেও, আমার ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে তারা মিটিং করেছে। সে মিটিংয়ে আমার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন নিয়ে রটনা-ঘটনা আলোচনা করে আমাকে সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে।

এই লেখাটা এক বন্ধুকে পড়তে দিয়ে বেরিয়েছিলাম বাসা থেকে এক জায়গায় যাবো বলে। তখন একসময় ছাত্র ইউনিয়ন করতো এমনই একজন আমাকে বললেন, ‘আপনি কেন এমন সমালোচনা করতে গেলেন মহিলা পরিষদের, আপনি নিজে সদস্য হয়ে এটা করা আপনার ঠিক হয়নি, ব্লা ব্লা ব্লা’। আমার কানে ঝাঁঝের মতোন লাগলো এমন ওকালতি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.