বিকলাঙ্গ জাতি- প্রতিবন্ধী বিবেক

Nadira Kiran
নাদিরা কিরণ, সাংবাদিক

নাদিরা কিরণ: বাংলা বর্ষের পহেলা দিনটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া বর্বরতার ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো সভ্যতার পোষাকের আবরণে কিছুতেই ঢাকা যাচ্ছে না এদেশের পুরুষের কাম-ক্রোধ-লালসার অবয়বটাকে। নারীর প্রতি আদিম তাড়না, লোলুপ দৃষ্টি আর অসভ্যতায় কলুষিত মনটা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ছে বারবার। লালসার লক্লকে জিহবা মুখ গহবরে কিছুতেই যেন থাকতে চাইছেনা আর।

নারী মানুষ নয়, সে কেবলই ভোগ্যপণ্য, কামনার খোরাক, তাদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করা চলে- এমন চিন্তাপুষ্ট কতোগুলো পুরুষের পৈশাচিকতার শিকার হলো কয়েকজন নারী। কিন্তু এ বিকৃত চিন্তা- ধারণার বাহক কি কেবল এই পুরুষ গুলোই? ঐ ঘটনা যারা অবলোকন করলো তারা কি এই ধ্যান-ধারণার বাইরে? কতগুলো কামুক পুরুষের বর্বরতা ঠেকানোর জন্যে ওখানে, ঐ গোটা শাহবাগ, চারুকলা, টিএসসিতে আর কতো পুরুষের জমায়েত দরকার পড়তো? সবার সঙ্গেই কি শিশু বা বয়স্ক মা ছিলো যে তাদের হাত ছাড়া করে বিপদে ফেলতে চাননি? বোন, বৌ বা বান্ধবী যারাই সঙ্গে থাকুন, নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিয়ে কেনো তারা ফিরে এলেন না অসহায় মেয়েগুলোকে বাচাঁতে? নিজে না সাহস পান, একা লিটন যখন সাহস করে এগিয়ে গেলো অতগুলো নরপিশাচকে ঠেকাতে, আরো কয়েকজন লিটনের বিবেক কেনো জাগ্রত হলো না? কেনো এগিয়ে গেলেন না তারা?

মুখ লুকিয়ে, পাশ কাটিয়ে গেলেন তারা। আর থেকে গেলো সেইসব পুরুষ যারা ঐ ঘটনার সূত্রপাতে ভুমিকা না রাখতে পারলেও শেষতক বর্বরতায় শামিল থেকে পুষিয়ে নিতে কার্পণ্য করেনি পৌরুষের আদিম বাসনা।

ঘন্টা খানেকেরও বেশী সময় ধরে কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের নারকীয় বর্বরতা যারা দাঁড়িয়ে দেখেছেন, তারা কি নপুংসক? যদি তাই হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। তবু আফসোস করে সান্ত্বনা পেতে পারতাম, উল্লাসের ভিড়ে সত্যিকারের পুরুষগুলো হয়তো সরে গিয়েছিলো অন্যত্র। আর ভুল করে কিছু নপুংসকের দল এসে পড়েছিলো সেখানে। আর কিছু করার মুরোদ না থাকায় অসহায় নপুংসকেরা লালসার জিহবায় লেহন করছিলো সেই দৃশ্য।

নাহলে নারীকে অর্ধনগ্ন করার দৃশ্য দেখেও কেনো বিবেক তাড়িত করেনি তাদের? আমরা কি বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিনত হচ্ছি? প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে কি গোটা জাতির বিবেক? নাহলে নির্লিপ্ত কেন আমরা?

বাংলা নববর্ষের প্রাণের মেলার মূল আয়োজন যে এলাকায়, বাঙ্গালীর ঐতিহ্য – সংস্কৃতির আনন্দযজ্ঞে শামিল হতে এতো মানুষের মিলনমেলা যে চত্বরে , সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তার বিষয়টিও কতটা নাজুক তাও প্রকট হয়ে জানান দিলো আবার।

মাত্র কিছুদিন আগেই ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সময় স্ত্রী রাফিদা বন্যার চিৎকারের পরও দীর্ঘসময় পুলিশের অনুপস্থিতি প্রশ্ন তুলেছিলো। আহত অবস্থায় পড়ে থাকা অভিজিৎকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাফিদার আকুতি সত্ত্বেও সেখানে উপস্থিত পুলিশ বা লোকজনের কেউই এগিয়ে আসেনি। তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই।

সেই পুলিশটির দায়িত্ব তবে কি ছিলো? খুনীদের ধরতে না পারলেও মানুষের বিপদে তাকে সাহায্য করবে না? এসব বিস্ময়বোধক প্রশ্নগুলো পাক খেতে খেতেই আবার সেই চত্বরে বিকেলের স্পষ্ট আলোতে ঘটে গেল এ তাণ্ডব!

সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় তা পরিকল্পনা করে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছিলো। পাশে পুলিশের উপস্থিতিও চোখে পড়ছিলো অনায়াসে। দীর্ঘসময় ধরে এমন অপকর্ম করার অপচেষ্টার সময় অদুরে লাঠি তুলে কিছুটা দায়সারা ভিড় ঠেলার মত কর্মকাণ্ড করেই ক্ষান্ত ছিলেন তারা। সিসি ক্যামেরায় শব্দ না এলেও উল্লাস আর হুলুস্থুলের শব্দ আর মেয়েদের আর্ত-চিৎকার কি কানে প্রবেশ করেনি তাদের? এতো নির্লিপ্ত ছিলেন তারা কিভাবে? কোথাও কোথাও পুলিশি উপস্থিতিও নেই। এতো বিশাল জনসমাবেশে তাহলে নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা কি ছিলো? পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করলেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কথা বলেন। এ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা আসলে কী?

দায় এড়াতে পারেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্যও। শিক্ষার পাদপীঠ, বাঙ্গালীর সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র, বাংলা ও বাঙ্গালীত্ব সৃষ্টির ইতিহাসে অন্যতম প্রধান স্বাক্ষর রাখা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। তিনি কতটা সোচ্চার হয়েছেন? কেবল গণমাধ্যমে -ন্যাক্কারজনক ঘটনা , দোষীদের শাস্তি দিতে হবে -এমন বক্তব্য দিয়েই দায়সারা হলে কী তার চলে? এ পাদপীঠকে এভাবে কলঙ্কিত করতে না পারে সেজন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য কেন তিনি সোচ্চার হননি ? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জড়ো করেননি- কেন জবাব চাননি – কয়েকজনকে ধরার পরও পুলিশ কেন তাদের ছেড়ে দিলো? তাদের শক্তির খুঁটি কোথায়? যে দলেরই হোক, অপরাধী অপরাধীই। তার জন্যে কোন ছাড় চলবে না। এমন জোরালো ভূমিকা কেনো আসেনি তাঁর কাছ থেকে? কিসের মোহে? উচ্চ শিক্ষার উচ্চাসনের চেয়ে মর্যাদার চেয়ে আরো কত বড় আসনের লোভে? এসব ঘটনার পরও সে আসনের মর্যাদাও কি থাকে? আর কতো ঘটনা ঘটলে তাঁর টনক নড়বে?

একই দিনে জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং এ ঘটনায় কয়েকদিন প্রতিবাদ, মিছিল আর টক শো’তে আলোচনা করে তীব্র প্রতিবাদ প্রকাশেই ক্ষান্ত হলে চলবে না আর। প্রয়োজন একটি সংঘবদ্ধ আন্দোলনের।

কেবল নারী সমাজ নয়, সচেতন সকল পুরুষদের শামিল হতে হবে সেই জমায়েতে। নিজেকে ঐসব নরপশু ও নপুংসকদের থেকে আলাদা করে তোলার  জন্যেই এটা জরুরী।

দরকার আরেকটি জাগরণী মঞ্চ করার। প্রকম্পিত চিৎকার তোলা উচিৎ এর বিরুদ্ধে। অপরাধীদের গ্রেফতার করে সাজা না দেয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে নারী নির্যাতনকারীদের হাতেনাতে ধরে এদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য কঠোর আইন ও বিধিমালা চাইতে হবে। নতুবা অনেকক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভিক্টিম মেয়ে বা তার পরিবারগুলোকে অনেক সময় নানা হুমকি ও জীবন নাশের ঘটনাও ঘটতে পারে।

সুতরাং আসুন, আমরা সামিল হই সেই মিছিলে। কাতারে কাতারে। আমাদের কারো ভুলে গেলে চলবে না- এ বর্বরতা কেবল নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য- সংস্কৃতি হরণ করার জন্যেও এ অপতৎপরতা।

আমাদের সংস্কৃতিকে বিলীন করে, আমাদের মুক্ত চিন্তাবোধকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের বীজ ছড়িয়ে দিতে চাইছে তারা। নারীরা ঘরে ঢুকবে, প্রভাত ফেরী বা আনন্দ মিছিল হবে না, ভোরের রাগ-ভৈরবী চলবে না – এমন আরো আরো অনেক অনেক ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকবে সেই অপশক্তিগুলো। তাই সকল সচেতন মানুষ পথে আসুন, আসুন মিছিলে, দলে দলে। জেলায় জেলায় সংঘবদ্ধ হোন। এর বিহিত না করে এ মিছিল হবে না শেষ।

নাদিরা কিরণ, অ্যাডিশনাল চিফ রিপোর্টার, এটিএন বাংলা

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.