এর চেয়ে ঘেন্নার আর কিছু নেই

Moonmoonশারমিন শামস্: বছর কয়েক আগের কথা। ডা্ক্তারের পরামর্শমত আমি আর আমার একজন সহকর্মী নিয়মিত হাঁটতে যেতাম। দু’জনের বাসা যেহেতু কাছাকাছি ছিল, তাই অফিসের সাথে সময় মিলিয়ে আমরা সপ্তাহে অন্তত চারদিন হাঁটতে পারতাম। রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের পাশ দিয়ে হেঁটে গণভবনের উল্টো দিক পর্যন্ত যাওয়া আর ফিরে আসা। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টা। হাঁটতে যাই, ফলে পরনে ট্রাউজার, ছোট ফতুয়া পরে নিই। পায়ে কেডস। তো প্রতিদিনের মত হাঁটছি একদিন। সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ রেসিডেন্সিয়ালের দেয়ালের কাছে আধো অন্ধকারে পিছন থেকে কেউ আমাকে জাপটে ধরলো। খুবই আপত্তিকর আর আতঙ্কজনক পরিস্থিতি।

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড় দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে লোকটা চলে গেল ইকবাল রোডের দিকে। তখন মাথা এলামেলো, তবু বুঝে ফেলেছি কী তার উদ্দেশ্য ছিল। আর মূহূর্তেই আমরা দুইজন চোখে চোখে তাকিয়েই শুরু করলাম ধাওয়া। চেঁচাচ্ছি আর ধাওয়া করছি লোকটাকে।

আমাদের চেঁচামেচিতে রাস্তার ঐদিকে থাকা এক লোক, সম্ভবত বাদাম বিক্রেতা, সে জাপটে ধরে ফেললো সেই লোককে। অবশেষে জমে গেল ভিড়, আমরা উপস্থিত হলাম।

এখন যা হয়, লোকজন জেরা শুরু করলো আমাদের। আমরা কেন বেরিয়েছি, কী ব্যাপার, বাড়ি কোথায়। এই দরিদ্র দেশে সাংবাদিকতায় পয়সা না থাকলেও, বিপদে আপদে উদ্ধারের সুযোগটা তুলনামূলক ভালো বলা যায়। সাংবাদিক, তাও আবার টেলিভিশনের, এই তথ্য পেয়ে কিছুটা মিইয়ে গেল লোকজন।

নাহ, এদের দোষ খুঁজে বের করাটা একটু ঝামেলার হয়ে গেল, ভাবছিল হয়তো। কিন্তু আমরা যে কী জিনিস, তাতো তারা তখনও পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি। আমরা ঠিক করেছি, বেজন্মাটাকে পুলিশে দেব। কিন্তু ভিড়ের লোকেরা তা করতে দেবে না। ‘আরে আপা, অভিযোগে লিখবেনটা কি? এতে তো আপনারই সম্মানহানি… ছিঃ ছিঃ ছিঃ… এসব লিখবেন কীভাবে?’

আমরা বলি, কেন? সমস্যা কোথায়? এই লোক নোংরা উদ্দেশ্যে আমার গায়ে হাত দিয়েছে। এখন একে ধরেছি। অতএব এবার যা করার পুলিশে করবে। নাহ, কিছুতেই তারা তা করতে দেবে না। আমরাও করবোই। শক্ত হাতে ধরে রেখেছি ঐ ব্যাটাকে। ছাড়বো না। অফিসে ফোন দিলাম। মূহূর্তেই সহকর্মীদের সহযোগিতা পেলাম। থানার দিকে রওনা হল তারা। পুলিশে ফোন করা হলো। পুলিশ আসলেন। গাড়িতে বসিয়ে সসম্মানে নিয়ে গেলেন আমাদেরও, যাতে অভিযোগ দায়ের করতে পারি। রাত এগারোটা পর্যন্ত সেই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে, লোকটাকে গারদে পুরে বাড়ি ফিরলাম। সংক্ষেপে এই হলো কাহিনী।

কিন্তু এইটা লেখার জন্য আসলে আজ কলম ধরি নাই। আসল কাহিনী হলো পরদিন। ভোরবেলা অফিস গিয়েছি। পাশে বসে কাজ করছেন আমার চেয়ে বয়সে অন্তত ১০/১২ বছরের বড় এক সহকর্মী। একথা-সেকথার পর হেহে করে হাসতে হাসতে অশ্লীল ভঙ্গিতে হঠাৎ বললেন, কাল হইছিলোটা কী বলতো? শুনলাম কি কি জানি হইছে তোমাদের সাথে… তো তোমাদের সাথেই হইলো কেন? মানে জানতে চাচ্ছি আর কি… তোমরা কি শাবনূর না মৌসুমী?’

যার কথা বলছি, সে অফিসে নানাভাবে সমাদৃত। তারে কেউ ছুঁতে পারে না। তারে সবাই ভালো পায়। তো এই শক্তির জোরে সে সেই ভোর সাড়ে সাতটায়, এই আমাকে এইসব বললো। তারপরের কাহিনী আর নাই বলি। তবে সেইদিন তার কথার প্রতিবাদ জানিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম বলে, পরে আমাকে নানাভাবে হেনস্থা হতে হয়েছে।

আজ যারা পয়লা বৈশাখে কিছু পুরুষের নোংরামি দেখে আহত হয়েছেন, ঘটনা পরবর্তী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় স্তব্ধ হয়েছেন, তারা জেনে রাখুন, এদের তাও চিহ্নিত করতে পারবেন। কিন্তু যারা সমাজের বড় বড় জায়গায় জ্ঞানী গুনী সেজে বসে থেকে ভিতরে ভিতরে বিষধর সাপের মত শ্বাস ফেলছে আর ছোবলের অপেক্ষায় আছে, তাদের চিনবেন কীভাবে?

এরা তো সমাজে সংসারে প্রগতিশীল আধুনিক মুখোশে আপনাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, আপনি জানতেও পারবেন না, এদের মুখের গরল কখন কীভাবে বেরিয়ে আসে, অন্তরের পাপ আর হীনতা কখন কীভাবে কোথায় তারা উগড়ে দেয়! ব্যক্তিগত জীবনে এরাও কন্যা সন্তানের পিতা হয়। মেয়েকে নিয়ে বিশাল সব স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পাশে বসা নারী সহকর্মীর অসম্মান তারা উপভোগ করে, নারীকে নানাভাবে অপমান করে তারা বিকৃত আনন্দ পায়। যে চিত্রনায়িকাদের নাম উল্লেখ করে তার অশোভন উক্তি, তাদেরকেও সে দেখেছে অসম্মান আর অবজ্ঞার চোখে। সমাজের কোন নারীকেই আসলে তারা সম্মান করতে শেখেনি। অথচ আজ তারা এমন কিছু স্থান দখল করে আছে, যেখানে সাধারণ মানুষের চোখে তারা বিরাট কিছু। এর চেয়ে ঘেন্নার এর চেয়ে আফসোসের আর কী হতে পারে!!

লেখক: সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.