ফারহানা আনন্দময়ী: পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাটি দেখলে এই চির-নৈরাশ্যের দেশেও আমি নতুন ক’রে আশাবাদী হয়ে উঠি প্রতি বছরেই। শুধু কি মঙ্গল শোভাযাত্রা, সারাদিনভর সারা দেশ জুড়ে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথ রাঙিয়ে তোলে আনন্দ আর উৎসবের রঙে। এ নিয়ে আমার সে কী গর্ব! বিদেশী বন্ধুদের খানিকটা অহংকার ক’রেই বলি, দেখো আমরা কীভাবে রাঙিয়ে তুলি বাংলা নববর্ষকে। ভেতর থেকে গেয়ে উঠি, ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ।‘
কিন্তু এতোসব আনন্দে যেন কালি লেপে দিলো পয়লা বৈশাখের বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আনন্দে মত্ত স্বাধীন চিত্তে ঘুরে বেড়ানো কিছু নারীর উপরে পুরুষরূপী কিছু পশুর বর্বর হামলার ঘটনাটি। শুধু কি টি এস সি’তে, না, খবরে দেখছি ঢাকাসহ দেশের বেশ কিছু এলাকাতেই এরকম অসভ্য ঘটনা ঘটানো হয়েছে। একজন নারী হিসেবে শুধু নয়, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এই খবরটি আমাকে বিক্ষুব্ধ করেছে, মর্মাহত করেছে, বাঙালি জাতির একজন নাগরিক হিসেবে লজ্জিত করেছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, স্পিকার একজন নারী, বিরোধীদলের নেতা নারী, অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলনেতা একজন নারী… তাঁরা কি এই খবরটি শুনেছেন, কিংবা পড়েছেন কোথাও ? নারীর ক্ষমতায়নের পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া এই পথিকৃতরা কি সেই আক্রান্ত নারীটির আর্তনাদ শুনতে পেয়েছেন? নাকি স্তবের ভুভুজেলার আওয়াজে প্রকাশ্যে ধর্ষিত সেই নারীর চিৎকার হারিয়ে গেছে ? হ্যাঁ, অনন্য আজাদের সঙ্গে একমত হয়ে কোনো নারীকে বিবস্ত্র করাকেও আমি একপ্রকার ধর্ষণই বলতে চাই।
হাজার হাজার মানুষের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাংলা বর্ষবরণের মত একটি জাতীয় উৎসবে একজন নারীকে একদল পুরুষ শারীরিক নির্যাতন করেছে… এরকম একটি ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদ শুধু নারীদেরকেই কেন করতে হবে ? নারীর পক্ষে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার শুধু নারীকেই কেন গর্জে উঠতে হয় ? এটা তো কোনো সভ্য সমাজের সংস্কৃতি নয়। আজ যেসব পুরুষ সমাজে নিজেদেরকে প্রগতিশীল ব’লে দাবী করেন, নিজেদেরকে সভ্য-শিক্ষিত ব’লে মনে করেন, নারীর অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকেন বিশেষ বিশেষ দিবসে… আমরা আজ তাঁদেরকে পথে দেখতে চাই, প্রতিবাদী মিছিলের অগ্রভাগে দেখতে চাই, একজন পুরুষ হিসেবে আরেকজন অপরাধী পুরুষের পক্ষে লজ্জিত হতে দেখতে চাই। আজই সেই দিন, প্রমান করুন… সমাজের সব পুরুষ একরকম নয়, সব পুরুষ শুধু কামুক পুরুষ নয়… তাঁরাও নারীকে যথাযথ সম্মানটুকু দিতে পারেন। নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমান করুন আজ।

এই পৃথিবীতে বিনোদনের কত মাধ্যম আছে, আনন্দ খুঁজে নেয়ার কত উপকরণ আছে… প্রকৃতি আছে, বই আছে, সঙ্গীত আছে, চিত্রকলা আছে, নাটক-সিনেমা আছে, দেশভ্রমণ আছে, আড্ডা আছে, রেস্তঁরা আছে… কতকিছু। অথচ এই আধুনিক যুগে পৌছেও কিছু মানুষ এখনও সেই আদিমই রয়ে গেছে। তাঁদের কাছে বিনোদনের একমাত্র উৎস যৌনতা। না,আমি যৌনতার বিরুদ্ধে কখনোই নই, প্রকৃতিতে যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটা অনুসংগ, মাঝে মাঝে যৌনতা শিল্পের পর্যায়েও পৌছে যায়। কিন্তু সেই যৌনতাকে কিছু সংখ্যক মানুষ জীবনযাপনের একমাত্র বিনোদনের বিষয় ক’রে তোলে। আমার তাঁদের জন্যে করুণা হয়। সুন্দর এই জীবনটায় সৃষ্টিশীল কিছুই তারা উপভোগ করলো না, ঘরে বসে পর্ণোগ্রাফি দ্যাখা, আর পথে বেরিয়ে অনাত্মীয় অপরিচিত নারীদেহে হাতড়াতেই তাদের সকল পুলক, সকল সুখ। বড্ড জানতে ইচ্ছে ক’রে আমার, যার সঙ্গে মানসিক কোনো সংযোগ নেই, একেবারেই অপরিচিত একজন নারীর দেহে মুহূর্তের জন্যে খামচে দিয়ে, চাপ দিয়ে কী ধরণের পুলক তাঁরা অনুভব ক’রে, এই বিকৃত রুচির মানুষদের কাছে জানতে চাই।
আরো একটা বিষয়, পয়লা বৈশাখের বিকেলের এই ঘটনাকে আমি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলতে রাজী নই। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা, একটা ষড়যন্ত্রের অংশ ব’লেই আমার ধারণা। নববর্ষ উদযাপনের দিনে এরকম আরো দু’দশটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারলে উৎসবটাকে বিতর্কিত ক’রে তোলা যায়। নারীদেরকে আরো একটু শাঁসানো যায় যেন এভাবে লাল-পাড় শাড়ি পরে, ফুলের মালা চুলে জড়িয়ে পয়লা বৈশাখে ঘরের বাইরে না বেরোয়। এইসব মৌলবাদীদের কাছে এগুলো বাঙালিয়ানা নয়, এসব হিন্দুয়ানি চর্চা… এরকম প্রকাশ্য নির্যাতন চালিয়ে ভীতির সঞ্চার ক’রে এইসব সার্বজনীন উৎসব থেকে নারীদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার একটা অপচেষ্টা।
গত পরশুদিন বৈশাখের প্রথম দিনে সাতসকালে বেরিয়েছিলাম আমরা পরিবারের সকলে নববর্ষ উদযাপনে সামিল হতে। আমরা মা-মেয়ে শাড়ির সঙ্গে হাত-কাটা ব্লাউজ পরেছিলাম। এখন ওই ঘৃণ্য ঘটনাটি যদি আমাদের সঙ্গে কিংবা আমার মেয়ের সঙ্গে ঘটতো, আমি নিশ্চিত অধিকাংশ মানুষই অভিযুক্ত করতো আমাদেরকে, কী দরকার ভাই এই পোশাকে এতো মানুষের ভীড়ে বেরোনোর। কই আর কারোর সঙ্গে তো হয়নি, তোমাদেরকেই কেন ওরা পেল এই আদিম লালসা মেটাতে। তাঁরাই আমাদের চরিত্রের কাটাছেঁড়া শুরু করতেন, হয়তো বলতেন, “কমলার এতগুলো কোয়া চরিত্রহীনতার লক্ষণ।“ আমি বলি কি, আমরা কিন্তু মানুষের ভীড়ে মিশে মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে মিলে উৎসবের আনন্দে মাততে চেয়েছি, পোশাকটা এখানে গৌণ, মানসিকতাটা এখানে মূখ্য।
আমরা কোনো নেকড়ের পালে বা শুয়োরের খোয়াড়ে নববর্ষ উদযাপন করতে বের হইনি। কিংবা পয়লা বৈশাখের সকালে চিড়িয়াখানার খাঁচা খুলে বাঘ-শিয়ালকে রমনা, টিএসসি, সিআরবি’তে আমন্ত্রণ ক’রে নিয়ে আসিনি। উৎসবের ভীড়ে হাজারো রঙিন মানুষের মধ্যে কোনো নারীর খোলা পিঠ বা খোলা বাহু দেখে যদি কোনো পুরুষ পুলক নিয়ন্ত্রণ ক’রতে না পারেন, তাহলে বলবো আপনারা পুরুষ নামের কলংক। আপনারা না পুরুষ, না মানুষ, আপনাদের ওই কুপুরুষ পৌরষত্বে আমি লক্ষ কোটিবার থুথু ছিটাই।
ওইসব পতিত পু্রুষদেরকে বলে যাই, বছরের একটা দিনে যেমন অধিকারের দাবীতে ‘নারী দিবস’ পালিত হয়, আপনারাও একটি দিন ওরকম বেছে নিন, ‘বিশ্ব পুরুষ দিবস’। যেদিনটায় আপনারা পতিত মানসিকতা থেকে নিজেকে উত্তরণ করে মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা করবেন।