‘টিএসসিতে গতকাল স্বাধীনতা বিপন্ন হইছে’

Flag 4পারভেজ আলম: গতকাল পহেলা বৈশাখে যে নারী নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটেছে, তা যে কতো ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা তা আজকে বিকালের আগে বুঝতে পারি নাই। আজকে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, আক্রান্ত নারীদের বাঁচাতে গিয়ে আহতদের সাথে কথা বলে যে অনুভূতি হয়েছে তা লিখে প্রকাশ করার ভাষা আমার নাই।

পুরো ঘটনাটি ঘটেছে এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কিশোরী থেকে সন্তান নিয়ে ঘুরতে আসা মায়েরাও ছিলেন। একেকজন নারীকে ঘিরে ধরে একেকটা গ্রুপ হামলা চালিয়েছে। এই পাশবিক অপরাধে লিপ্ত ছিল তরুণ থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত। এদের হাত থেকে আক্রান্তদের বাঁচানোর জন্যে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় রীতিমত লড়াই করেছে ছাত্র ইউনিয়নের ৩/৪টা ছেলে মাত্র।

সুপরিকল্পিত নারী নির্যাতকদের সাথে যেমন সুযোগ সন্ধানিরা মিলে মব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে এই ৩/৪টা ছেলের সাথে মিলে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো মানুষ ছিল না, এক পর্যায়ে তাদের সংগঠনেরই আরো ৫/৬জন যুক্ত হয়েছিল তাদের সাথে। আক্রান্তদের বাঁচাতে গিয়ে তাদের একজনের হাত ভেঙেছে, আরো কয়েকজন আহত হয়েছে। তারা অপরাধীদের মধ্যে ৫/৬ জনকে আটক করে পুলিশের হাতেও তুলে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পুলিশ পুরো ঘটনায় প্রায় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে এবং আটককৃতদেরকেও ছেড়ে দিয়েছে।

তো এই হইল আমাদের পহেলা বৈশাখ উদযাপনকারী বাঙালি জাতির অবস্থা। যারা পহেলা বৈশাখে ঢাকার সবচেয়ে কেন্দ্রীয় উৎসবের স্থানটিতে এই ধরনের ভয়াবহ, পাশবিক একটা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়, ঘটতে দেয় অথবা তার প্রতিরোধ করে না, প্রতিবাদেও তাদের খুব একটা উৎসাহ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

এই বাঙালিই আবার পাকিস্তানীদের বর্বর, অসভ্য, ধর্ষক ইত্যাদি বলে গালাগালি করে। অপরকে গালি দেয়ার মতো সভ্য আমরা হইছি কি? কোন বাঙালি মেয়ে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের ‘মেরি মি’ বললে যাদের বাঙালিত্ব জেগে ওঠে, যারা একাত্তরের ধর্ষিতাদের প্রসঙ্গ টেনে আনেন, এখন কেনো চুপ তারা? বাঙালি মেয়েদেরকে বাঙালি পুরুষ নির্যাতন করলে বাঙালিত্ব জাগবে না? একাত্তরের কোন চেতনাও মনে আসবে না? আমাদের জাতীয়তাবাদ এখনো পুরুষতান্ত্রিকতা অতিক্রম করে নারী পুরুষ উভয়ের জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠতে পারে নাই। এই জাতীয়তাদ নিয়া আমাদের কিসের এতো গর্ব? এই অপরাধের বিচার না করে আপনারা কোন মুখে গর্ব করবেন? কোন মুখে ঐ বাঙালি মেয়েদের সমালোচনা করবেন যারা প্রেম প্রকাশে বাঙালি-পাকিস্তানী পার্থক করে না?

পহেলা বৈশাখ আমাদের হাজার বছরের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির উৎসব। এই উৎসবে বাঙালি নারীদের উপর গণ নির্যাতন হয়েছে। অপরধী গ্রেফতার হয় নাই। জনতার হাতে ধরা পরা অপরাধীদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। দুই একদিন ফেসবুকে ও শাহবাগে কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হবে। তারপরে আমরা সবাই মেয়র নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবো। এই হইল আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি নিয়া গর্ব করবেন? না কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং বিচারও করবেন?

একাত্তরে যাদের জন্ম হয় নাই এবং মুক্তিযুদ্ধ না করায় যাদের আফসোস আছে, তারা একটু নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, একাত্তরে থাকলে আপনি আদৌ কি করতেন?

এখন আপনি কি করছেন তা বিচার করে আমি বলবো না যে, একাত্তরে আপনি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না। কারণ, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। গতকাল সন্ধ্যায় টিএসসিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে, বাঙালি সংস্কৃতি অস্তিত্বের সংকটে পরে গিয়েছে। এখন কি করবেন আপনারা?

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.