শারমিন শামস্: বহু বছর আগে থার্টি ফার্স্ট এর রাতে বাঁধন নামে একটি মেয়েকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। সে সময় বিষয়টি নিয়ে নানা তর্ক-কুতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, মনে আছে। আগে একুশে বইমেলায় প্রায়ই শুনতাম মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা হচ্ছে।
তারপর ধীরে বিষয়টি কমে আসলো। অন্তত উৎসব স্থলগুলোতে মেয়েরা কিছুটা নির্বিঘ্নে চলাফেরার মত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেতে শুরু করলো। বৈশাখের উৎসবে কিছু নপুংসক সুযোগ পেলে মেয়েদের শরীরে হাত দেবার মত বিকৃত আনন্দের জন্য আসতো একসময়, সে প্রায় ৮/১০ বছর আগের কাহিনী। এই জঘন্য বিষয়টিও গত কয়েক বছরে অনুভব করিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, চারুকলায়, টিএসসিতে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটছে, কিন্তু সে আনন্দ উৎসবের মধ্যে নিরাপত্তা আর সচেতনতার প্রভাবে আর কোন বিকৃত রুচির পুরুষ সুযোগ করে উঠতে পারেনি গত কয়েক বছর।
গতকাল এই ১৪২২ বঙ্গাব্দে, এই ২০১৫ সালে হঠাৎ সেইসব বিকৃতমস্তিস্ক লোক তাদের লালসার লকলকে জিহ্বা নিয়ে আবার বেরিয়ে আসার সাহস পেল কীভাবে, বিষয়টি নিয়ে ভেবে কূল কিনারা করতে পারলাম না। মাথায় শুধু ঘুরছে একটিই কথা, এটি উদ্দেশ্যমূলক নয়তো? বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী উৎসবের গায়ে কালি মাখিয়ে দিতে তৎপর বিশেষ কোন গোষ্ঠীর ‘সুচিন্তিত’ পরিকল্পনার অংশ নয় তো এটা?
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈশাখী উৎসবের বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা দেখাছি, তা তো এই ইঙ্গিত দেয়, একটি বিশেষ মহল কিছুতেই নির্বিঘ্নে এই উৎসব মেনে নিতে পারছে না। রমনার বটমূলে বোমা মেরেও ছায়ানটের গান বন্ধ করতে পারেনি তারা। উদিচীর কণ্ঠরোধ করতে পারেনি। হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে মানুষের বৈশাখ পালন থেমে যায়নি এতো রক্ত ঝরানোর পরও। বাঙালি ঠিকই তার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।

মঙ্গলশোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছে সব বয়সের মানুষ। কোনভাবেই তারা বন্ধ করতে পারেনি এই জনস্রোত। অস্থিরতায় কী ভোগেনি সেই মহল? তারা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে তবে? আমি বিশ্বাস করিনা। গতকাল হাজার হাজার মানুষের সামনে কিছু তরুণীর পোশাক ধরে টানাটানি করে তারা তাদের অপদস্থ করে প্রমাণ করতে চেয়েছে, বৈশাখী উৎসবের নামে বাঙালি আসে বেলেল্লাপনা করতে।
তারা বোঝাতে চেয়েছে, বৈশাখী উৎসবে মেয়েরা নিরাপদ নয়। এই বার্তাটি কোনভাবে কিছু মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই তো অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। অন্তত শ’দেড়েক অভিভাবকের মাথায় যদি ঢোকানো যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈশাখের উৎসবে তার কন্যা নিরাপদ নয়, তবেই তো সামনের বছর নববর্ষে বেশ কিছু দ্বিধান্বিত মানুষ বৈশাখী উৎসবে আসবেন না। ব্যস, সফল তারা। এভাবেই একটু একটু করে সিঁদ কাটতে কাটতে এগোনেই তো তাদের নীতি, তাদের কৌশল।
আমি খুব হতাশ হয়েছি, গতকালের ঘটনার সংবাদ প্রকাশে কিছু মিডিয়ার ভাষা ব্যবহারে। ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দের অর্থও খুঁজলাম অভিধানে। দেখলাম, লেখা আছে, নারীর সম্ভ্রমহানি। অভিধানের চোখেও শুধুমাত্র নারীই সম্ভ্রমের অধিকারী, তাই সম্ভ্রমহানি নারীরই হয়। পুরুষের সম্ভ্রমহানি বিষয়টি নেই। পুরুষকে ন্যাংটো করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখলেও তার সম্ভ্রমহানি হবে না। কিন্তু নারীর শাড়ি কি ওড়না ধরে টান মারলেই ‘শ্লীলতাহানি’! তা বেশ। এরকম শ্লীলতাহানি তো রোজই হচ্ছে। পথেঘাটে, যানবাহনে, দোকানেপাটে।
আমার নিজেরই তো একশবার হয়েছে। তো এখন এই দক্ষ মিডিয়ার ভাইবোনেরা, আপনারা নিউজ করুন রোজ একশটা। ‘শ্লীলতাহানি, শ্লীলতাহানি, শ্লীলতাহানি।’ আমি খুব অবাক নই। অভিধান থেকে শুরু করে মিডিয়া, সবই তো পুরুষতন্ত্রের ছাগশিশুদের দ্বারা পরিচালিত। তারা মেয়েদের উত্যক্ত করার সংবাদ লিখতে গিয়ে নারীর শ্লীলতাহানির রগরগে কাহিনী ফাঁদবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
বৈশাখের উৎসবে দায়িত্ব পালনরত একগাদা পুলিশ র্যাবের সামনে মেয়েদের কাপড় ধরে টানাটানি করলো কিছু পুরুষ, নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখলেন। এটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক। অভিজিৎ রায়কে, হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে এদেরই সামনে। তাই আমি আর এদের কাছে কিছু আশা করি না। তবে হ্যাঁ, ভালো লেগেছে আমার। একজন সাহসী ভাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাই লড়েছেন। আহত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এক নারীকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। স্যালুট তাকে। হাজার হাজার পুরষের মাঝখানে ঐ একজনই মানুষ, লিটন নন্দী। আর কিছু বলার নেই।
এখন আমাদের শুধু ভাবতে হবে? ভাবতে হবে মেয়েদেরও। আরো সাহসী আরো প্রত্যয়ী হয়ে ওঠা ছাড়া এ থেকে নিস্তার নেই। কেউ আপনার জামা ধরে টানলেই আপনার সম্ভ্রম যাবে না। সম্ভ্রম ইজ্জত লজ্জা তো গেছে তার, যে টানছে জামা ধরে, যারা দায়িত্ব পালনের নামে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, যারা উৎসবস্থলে এই ঘটনা দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। ধিক তাদের। আপনি আরো সাহসী হোন মেয়ে। সাদা-লালে নিজেকে সাজিয়ে আবারো মেতে উঠুন বৈশাখী উৎসবে। আপনার চোখ মুখ, আত্মপ্রত্যয় দেখে যেন নোংরা রক্তবীজের ঝাড় আশেপাশেই ঘেঁষতে না পারে।
আর ভেবে দেখুন গণমাধ্যম। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন কয়েকজন নারী।’— এই কদর্য ভাষা, অসচেতন ভাষা ব্যবহার বন্ধ করুন।
আর ভেবে দেখতে হবে সাধারণ মানুষকে। কারা কালিমা লেপতে চায়, কারা বন্ধ করতে চায় এই উৎসব। আসুন রুখে দাঁড়াই। আরো উজ্জ্বল আরো জমকালো আয়োজন করি আগামী বছরের পয়লা বৈশাখে। পয়লা বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠুক।
লেখক- সাংবাদিক