যা কিছু আমাদের…

New Yearইশরাত জাহান ঊর্মি: প্রতিবছর খুব সেজেগুজে, দারুণ দহনে পুড়ে, যানজটে আটকে হাত কামড়ে, অফিসে হৈ-হুল্লোড় করে আবার দিনশেষে ক্লান্তিতে সেই অফিসকেই গালি দিয়ে, বাড়িতে দুএক পদ রান্নার চেষ্টা করে “মোটামুটি” দারুণ এক পহেলা বৈশাখ পার করি। এবার কামারুমুক্ত (কামারুজ্জামান) পহেলা বৈশাখে কিছু কথা মনে আসছে।

মনে হচ্ছে, এই যে সার্বজনীন একটা উৎসব, এই যে একমাত্র ধর্মমুক্ত একটা উৎসব, যে উৎসবের জন্য রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে আসা কতগুলো মানুষগুলোকে প্রাণ দিতে হলো, সেই উৎসবটাও একদিনে তো হয়নি। যেকোন জাতি আর জাতি-রাষ্ট্রেরই আসলে নিজস্ব কিছু থাকা খুব জরুরী। উঠে দাঁড়াতে হয়, ঘুরে দাঁড়াতে হয় নিজস্বতা দিয়েই। নিজস্ব যূথবদ্ধতা দিয়েই। সম্রাট আকবর শুরু করেছিলেন বাংলা সন গণনা। এর আগে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় হতো। কিন্তু বাংলার কৃষি তো আর হিজরী সনের চাঁদ মেনে চলে না। তাই বাংলার নিজস্ব সন গণনার প্রয়োজন পড়ে। আমরা তো দরিদ্র নই বা ছিলাম না তাই নিজস্বতা দিয়েই পঞ্জিকা রচনা। এখন সম্রাট আকবরেরও সমালোচনা করতে ছাড়ে না ছাগুরা। সম্রাট আকবর অগ্নি উপাসক ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

তা যাই হোক, আজ পহেলা বৈশাখ খুব রঙীন। কিন্তু মাত্র দেড়দশক আগেও পরিস্থিতি কিন্তু এরকম দেখিনি। আমি একটা পরিবারকে চিনি যারা সর্বোতভাবে পাকপন্থী। যাদের বাড়িতে ইনকিলাব রাখা হতো, পাকিস্তানী সালওয়ার কামিজ, পাকিস্তানী কাবুলী সেট যাদের প্রধান পরিধেয় ছিল। বছর কয়েক আগেও সেবাড়ির গৃহকর্ত্রীকে পহেলা বৈশাখে মঙ্গলশোভা যাত্রায় মানুষের ভিড় দেখে টিটকারী করে বলতে শুনেছি, খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই, এই রোদের মধ্যে সব হেঁটে বেড়ায়, আর কিসব হিন্দুয়ানী!.. ইনকিলাবের হেডলাইন দেখেছি মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে, “ ভারতের জাতীয় পাখী ময়ূরের প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল”।

দেড়দশকে একটা প্রজন্ম বদলেছে। ঐ বাড়িতে ছেলের বউ এসেছে, মেয়ের জামাই এসেছে। এখন কি আশ্চর্য্য, ঐ বাড়িতে পহেলা বৈশাখ পালন হয়। আত্নীয়-স্বজন আসে। যে বাড়ির মূল খাবারই হলো মুরগী মোসাল্লাম আর গরুর কাবাব, ভর্তা-টর্তা গরীবে খায় মনে করে যারা, তাদের সেই বাড়িতে কি আশ্চর্য্য, পহেলা বৈশাখের দিন ভর্তা আর তরমুজের রস! মেয়েরা লাল-সাদা নকশা করা পোশাক পড়ে, ছেলেরা রঙ-এর পাঞ্জাবী।

না বন্ধুগণ, মনে করার কোন কারণ নেই যে একটা পরিবার আমূল পাল্টে গেছে। মেয়েরা যে লাল-সাদা নকশার পোশাক পড়ে সেটাও কিন্ত ইন্টারনেট থেকে নামানো পাকিস্তানী ডিজাইনেরই। ভর্তা-টর্তা খাওয়া অনেকটা একদিনের ফ্যাশন, এটা তাদের প্রাকটিস নয় এখনও। কিন্ত আমি ভাবি, তাইবা কম কি? ফ্যাশন যদি করতেই হয় বাঙালী সংস্কৃতির ফ্যাশনই করুক। একদিনের জন্য হলেও এইযে লাল-সাদা পোশাক অর্থাৎ পহেলা বৈশাখকে সমীহ করা, এটাও তো অর্জন।

আমি যে পরিবারটার কথা বললাম, তারা উ্চ্চবিত্তের। মঙ্গলশোভাযাত্রায় উচ্চবিত্তরা যায় বলে শুনিনি বিশেষ, বাঙলাগানও মধ্যবিত্তরাই শোনে। কিন্তু চারুকলার টিএসসি থেকে গুলশান-বনানীতে এইযে পহেলা বৈশাখের ছড়িয়ে পড়া-কম কথা নয় কিন্তু। হ্যাঁ নানানরকম বাণিজ্যে বসতি আছে এর মধ্যে, আছে ইলেশী হুজুগ। কিন্তু মোদ্দা কথা যেটা বলতে চাইলাম আমি, তা হলো, আমরা পেরেছি। আমরাই চেঞ্জমেকার।আমরা মানে স্বল্পবিত্তের মানুষেরা আর গণমাধ্যম। তাঁতের শাড়ি আর মাটির গয়না পড়েও যে ফ্যাশন করা যায়, মাটির রঙীন হাঁড়ি আর পাটের শিকা দিয়েও ঘর সাজানো যায় এবং এরকম সাজতে আর সাজাতে সাজাতেই তা জীবন আচরণের অংশ হয় তা আমরা প্রমাণ করেছি।

১৯৬৭ সালে আইয়ূব শাহীর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে এ অঞ্চলে পহেলা বৈশাখ পালন শুরু। মঙ্গলশোভাযাত্রা নিয়ে তো জামাতীদের যন্ত্রণার অন্ত নেই, এত্ত এত্ত হিন্দুয়ানী তারা যে কত্ত্ব কষ্টে সহ্য করে তারাই জানে! জামাতীদের চাপাতিগুলা বসে বসে কান্দে।

কিন্তু আমরা পেরেছি। যারা বাঙালীর নিজস্বতায় দাঁত কিড়মিড় করে তাদের প্রতি করুণা জানিয়ে অন্য সবাইকে শুভ নববর্ষ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.