তানিয়া মোর্শেদ: কয়েকদিন আগে আমার ছেলে দীপ্ত স্কুল থেকে ফিরে ভীষণ ক্ষুব্ধ। ইংরেজী সাহিত্যের ক্লাসে একটি বই পড়ছে। The Jungle by Upton Sinclair. বইটিতে একজন নারীর ধর্ষিত হবার কথা, বর্ণনা আছে। ক্লাসের একটি ছেলে এই বিষয়টি নিয়ে হেসেছে! খুব মেধাবী ছেলে। না মেধার সাথে অনুভূতিশীলতা পরিপূরক নয়!
ছেলেটির হাসি দীপ্তকে ভীষণভাবে রাগান্বিত করেছে। বাড়ীতে ফিরে অনেক কথা বলেও কমেনি। ও কিছুতেই ভাবতে পারে না, ধর্ষণের বিষয়ে কেউ অনুভূতিহীন হতে পারে, হাসতে পারে! যেদিন জেনেছিল, পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকাররা বাংলাদেশে ২~৪ লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছে সেদিন রাগে ফুঁসেছে শুধু। ক্লাসের ছেলেটিকে বেশ কিছু কথা বলেছে, তবে ওর ইচ্ছে ছিল আরো কিছু বলার। কিন্তু ক্লাসের মধ্যে বেশী কথা তো বলা যায় না। এক পর্যায়ে বলেছিল, ক্লাসের বাইরে হলে হয়ত আমি তাকে পাঞ্চ করতাম!
জীবনে কাউকে একটুও না মারা ছেলে (ছোট্টবেলায় বন্ধুদের মার খেয়েও কোনোদিনও খামচিও দেয়নি!) এই কথা বলেছে। সেদিন অনেক কথার এক পর্যায়ে বলেছে, সে কোনোদিনও রাজনীতিতে ও সেই সূত্রে ক্ষমতায় যেন না যায়! তাহলে আইন করে সব ধর্ষককে ফাঁসী দেবে! কিছুতেই তার রাগ কমে না দেখে এক পর্যায়ে বললাম, তোমার যদি এত রাগ ও কষ্ট হয় তাহলে ভাবো সেই সব নারীদের কথা (১৯৭১-এর ধর্ষণের শিকার নারীদের কথা)। এত বৎসর শুধু বিচারহীন হয়েই থাকেননি, পরিবার ও সমাজ তাঁদের কোথায় ছুঁড়ে ফেলেছে!
সে বললো, “আমি সব জানি মা। সে কারণেই আরো বেশী রাগ। ভারতীয় উপমহাদেশীয়রা এই নারীদের যেভাবে দেখে তা আমি জানি। তোমার কি মনে হয়, ছেলেটি কেন এমন করেছে!” উলটো প্রশ্ন আমাকে! তাকে আগেই বলেছি, কিভাবে ধর্ষণকে সম্ভ্রমহানি বলে আমাদের দেশে! সেখান থেকে অনার কিলিং বিষয়েও বলেছি।
ধর্ষণ বিষয়ে তার প্রথম প্রশ্ন জন্মেছিল যখন এইট গ্রেইডে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে রিসার্চ করেছিল নিজের রুটের কোনো বিষয়ে প্রজেক্টে কাজ করতে যেয়ে। সে নিজে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে এসেছিল প্রজেক্টে! আমি এক পর্যায়ে বলেছি, এরপরে কখনো সেই ছেলে এমন করলে ওকে বলো সে যেন তার মায়ের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে।
ভাবলাম, সেই ছেলে একদিন পড়া ও ক্যারিয়ার দিয়ে সমাজের একজন মাথা হবে, অথচ তার ভেতরে রয়ে যাবে এই অমানবিকতা! বাবা-মায়েরা পড়া, ক্যারিয়ারের উচ্চ পর্যায়ে সন্তানকে পৌঁছে দেবার জন্য সেই কোন শিশুবেলা থেকে এতো মনোযোগী আর ব্যাতিব্যস্ত যে কোনো খেয়াল নেই মানসিক দিক দিয়ে কতটা মানবিক হচ্ছে সন্তান!
এই ট্রাডিশন এখন চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ আরো কিছু দেশ থেকে এদেশেও আমদানী হয়েছে! পড়া, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়া, ক্যারিয়ারের শিখরে ওঠা, বিশাল বাড়ী, ভীষণ দামী গাড়ী ও অন্যান্য সব বৈষয়িক জাগতিক সব অর্জন ও ভোগ, এটাই সব!! মানবিকতা কেঁদে মরে একাকী!!
গতকাল সোহাগপুরের বিধবা পল্লীর কথা বলেছি দীপ্তকে, ছবি দেখিয়েছি। অনেক কথার পর বলেছি, এদেশে কলেজে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) ধর্ষণ একটি খুব কমন ব্যাপার। অনেক মেয়েই এর শিকার হয় সেখানে। বলেছি, আমি আশ্চর্য হই, এদেশে সবার সমান অধিকার (কাগজে হলেও), ছোট্টবেলা থেকে সব জায়গায় সমান উপস্থিতি, আইন ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত, তারপরও কেন এমন হয়!
এক পর্যায়ে ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কবে থেকে পুরুষ নারীর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে? কেন করেছে? তারা কি বুঝেনি যে সমান অধিকার থাকলেই জীবন ও পৃথিবী সুন্দর হতো!
বলেছি, অনেক পুরুষ হয়ত কিছু চিন্তা না করেই পুরুষতান্ত্রিক। মানে তারা জানেই না তাদের আচরণ পুরুষতান্ত্রিক। তারা সমাজের, পৃথিবীর পুরুষতান্ত্রিকতার ধারাবাহক কিছু না ভেবেই। বেশীর ভাগ মানুষই ফলোয়ার। আর ধর্মের বিশাল ভূমিকা আছে এখানে। ধর্মের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিকতাকে মানুষের ব্রেইনে খোদাই করা যায় সহজে! তাই পুরুষ ও নারীও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও আচরণ করে। কারণ, ধর্মে আছে! ক’জন তা প্রশ্ন করবে, করে? প্রশ্নের আগে আসে চিন্তা। চিন্তাই করবে না তো প্রশ্ন! আর প্রশ্ন করলেও প্রতিবাদ?! বলেছি, কোনোদিন কোনো কিছুর ফলোয়ার হয়ো না। চিন্তা করবে আগে। বুঝবে। যদি কোনো বিষয়ে চিন্তা না করতে চাও, করো না। কিন্তু চিন্তা না করে ফলোয়ার হয়ো না। বি অ্যা থিঙ্কার।
এক পর্যায়ে ও বলেছে, ওর যদি মেয়ে সন্তান থাকে তাহলে তাকে আমার মত স্ট্রং করে বড় করবে! আমি বলেছি, আমি অত স্ট্রং নই। সে আমার থেকেও অনেক বেশী স্ট্রং হবে। তারপর বলেছি, তুমি হয়ত একদিন পড়বে, আমি কি লিখেছি।
আমি লিখেছিলাম, আমার কন্যা সন্তান থাকলে তাকে এতোটাই স্ট্রং, এতোটাই অন্যায়ের প্রতিবাদী করে বড় করতাম যে, এ পৃথিবী নিতে পারতো না! হয়ত প্রকৃতি বুঝেছিল আমার মনোভাব, তাই আমার কন্যা সন্তান নেই! এরপর ওর প্রশ্ন, কবে কিভাবে বাবা-মা বুঝে কখন কি কথা সন্তানকে বলতে হয়?
আমি বলেছি, প্রথমে সেই বন্ডিং তৈরি করতে হয়, তারপরে সময়ই বলে দেয়। যেমন ওর সাড়ে ছয় বৎসর বয়সে আমার ক্যান্সার যুদ্ধ শুরু, অথচ আমি বলেছি ওর যখন প্রায় এগারো তখন। এদেশে বলে সাথে সাথে বলে দিতে। আমি ডাক্তারদের বলেছি, এখন নয়। আমি জানি আমার ছেলেকে। আরো পরে বলবো। যদিও যত পরে বলতে চেয়েছে তা পারিনি! একদিন সে আমায় ধন্যবাদ দিয়েছিল, দেরীতে বলবার জন্য। বলেছিল, সাড়ে ছয়ে সে নিতে পারতো না!
গতকাল আবারো ধন্যবাদ দিয়েছে, সময়ের আগে নয়, ঠিক সময়ে ধর্ষণ বিষয়ে কথা বলবার জন্য। এর আগে হলে সে নিতে পারতো না। এখনো না বললে যদি চলতো, ভাবি! কিন্তু পৃথিবী তো তা নয়!