আতিকা রোমা: ছোটবেলায় মার্চ-এপ্রিল মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা ও গ্রীষ্মকালের বন্ধ থাকতো ইস্কুলগুলোতে। আলাদা করে পহেলা বৈশাখের কোন বন্ধের কথা মনে পড়ে না। রংপুর শহরে আমাদের বিশাল বাড়ীটায় তখন নানান জায়গা থেকে আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে আসতো, আমরাও ঢাকায় মামা খালাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসতাম ১৩/১৪ ঘন্টা বিআরটিসি বাসে চড়ে, ফেরী করে যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে।
আমার “ভীষণ রকমের কড়াকড়ি মা” এই পুরো সময়টাতেই ছুটি কাটাতেন ছেলে-মেয়েকে অনেকটা সময় দেবার জন্য। অন্যদিকে তিনি কড়াকড়ির জন্য এতোটাই বিখ্যাত ছিলেন যে, অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীরা ইস্কুলে গিয়ে জেনে আসতো আমার মা পরীক্ষার হলে ডিউটি করবেন কিনা। তাই স্বেচ্ছায় তিনি এই কাজ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং আর সবার মতো বোর্ডে গিয়ে খাতা নিয়ে এসে দেখা বা পরীক্ষার হলে ডিউটি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং তাতে করে আমার কপালখানা একটু আধটু পুড়েও যে যেত, সেটা বলাই যায়। আমি শুধু মনে মনে অপেক্ষা করতাম, কবে আমার মা আবার ইস্কুলে যাওয়া শুরু করবে।
মার্চ মাস পড়লেই বেলা ১১টা/১২টার সময় বাড়ীর সবাইকে তেঁতুলের পানির সাথে গুড় গুলানো এক অদ্ভুত পানীয় বাধ্যতামূলকভাবে পান করানো হতো। অনেকেই সেই দ্রব্য উৎসাহ নিয়ে পান করলেও, আমার কাছে বিভীষিকা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না।
শুধু কি তাই? এসময় যত্রতত্র ঘোরাঘুরি, ছোটাছুটি সবই খুব নিয়ন্ত্রিত। রোদে খেলা যাবে না, বিকালে সূর্যের তেজ না কমে যাওয়া অব্দি তাই বারান্দায় বসে বসে ক্যারাম, লুডু বা মনোপলি খেলা ছাড়া আর কপালে কিছুই জুটতো না। বেশী খেলা হতো ক্যারামটাই। খেলে খেলে আমরা ছোটরা এক এক দিন আঙ্গুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানিয়ে ফেলতাম। রাতে পড়তে বসলেই শুধুমাত্র এটা খুব ভাল করে বোঝা যেত।
বাড়ির উঠোনটি বেশ বড় থাকায় আমাদের বাড়ীতেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলতে আসতো। কাজেই আমাদের বাইরে যাওয়াটা আরো সীমিত হয়ে যেত। চাচাতো বড় ভাই ও ওদের বন্ধুরা ক্যারামে ‘বোর্ড গেম’ খেলতো। খেলার জন্য ওদের নানান ধরনের বাহারী স্ট্রাইকার ছিল, ছিল অনেক অনেক বোরিক পাউডার। গুটিতে হাল্কা টোকা দিলেই গুটি পকেটে পড়ে যেত মাখনের মতো। এই বরিক পাউডার আসলে কতোটা দামী ছিল আমি জানি না, তবে বড়দের কাছে একমাত্র আমি অনুনয়-বিনয় করলেই তারা একটু আধটু মূল্যবান বোরিক পাউডার আমাকে দিত। এ কারণে আমার সাথীরা কেউই আমাকে খেলা থেকে বাদ দিত না।
আমরা ছোটরা একটা সাদা গুটির ওপর একটা কালো গুটি বসিয়ে কলা গাছ বানিয়ে খেলতাম। সাদাগুটির মান ১০, কালোটি ৫ আর লালটি সবচেয়ে দামী ২৫। লালটি থাকতো কলাগাছের মাঝামাঝিতে। বোর্ড খেলা আমাদের ছোটদের টানতো না, কলাগাছের উত্তেজনার কাছে বোর্ড খেলাটা নেহাতই সাধারণ মনে হতো। সারাদিন ক্যারাম খেলে খেলে আমরা ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করতাম সূর্যের তেজ কমে যাবার। এক-একদিন মনে হতো সূর্যটা আস্ত বজ্জাত, তেজ কমার কোন লক্ষণই থাকতো না যেন।
চৈত্র মাসে ভাতের সাথে আবশ্যিকভাবে কিছু খাবার খেতে হতো, যেমন, করলা ভাজি, পাট শাক বা পাট শাকের স্যোলকা (রংপুরের একটি আঞ্চলিক খাবার)। করলা ভাজিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে খাবার বলে আমার মনে হতো। আর সকালে খালি পেটে চিরতার পানি খাবার ভয়ে ঘুমের ভান করে কতোদিন যে পরে থেকেছি, হিসেব নেই। স্যোলকাটা ভাল লাগতো। সবুজ পিচ্ছিল একটা খাবার, ভাতের সাথে মাখলে ভাত সবুজ হয়ে যেত আর চাবানোর কষ্টটাও কমে যেত। মুখে পুরলেই সেটা সুরড়ুত করে পেটে চলে যেত। আর একটি অসহ্য খাবার ছিল, সজনে ডাঁটা। ভাতের সাথে খেতে চাইতাম না বলে খাবার শেষ করে বসে বসে অন্তত ৫/৬টি টুকরা চিবিয়ে খেয়ে তবেই ছাড়া পাওয়া যেত।
ততোদিনে গাছে গাছে আমের মুকুল এসে যেত। মুকুলগুলি একটু আধটু বড় হয়ে গুটিগুটি আম ধরতো। সেসময় আমার হাতের নিশানারও খুব নামডাক ছিল। আমি আমাদের বাড়ির বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়াপড়শীদের বাড়ির গাছেও বিস্তর ঢিলাঢিলি চালাতাম। তবে আমাদের বাড়ীর পেছনে দেয়াল ঘেরা একটি বাগান ছিল আমাদেরই, যেখানে ছোটদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। কারণ যখন-তখন সেখানে “বাঘডাসা” (বনবিড়াল) বেরুতো। তারপরও আমি সেখানে যেতাম একা একা, চুপিচুপি। কারণ ঐ বাগানটা ছিল স্বপ্নপুরীর মতো, ছায়া ও মায়ায় জড়ানো। গাছে গাছে নানান পাখি কিচিরমিচির করতো, ঘর বাঁধতো, ডিম পারতো। আমি খুঁজে খুঁজে তাদের দেখভাল করতাম। কখনও কোন ছানা বাড়ী গলিয়ে নীচে পড়ে গেলে তাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কখনও নিজে নিজেই আবার কখনও বা বড়দের ডেকে এনে।
একদিন কঠিন করে সব তিতা খাবারের সমারোহ হতো, শুনতাম চৈত্রসংক্রান্তি, মানে কিছুই বুঝতাম না। ভাবতাম সারা বছরের তিতা সব খাবার আজকেই খেয়ে ফেলা হবে এবং বছরে অন্য কোন সময় জঘন্য চিরতার পানি ও করলা ভাজি খেতে হবে না। আমি শুধু এই ভাবনা নিজের মধ্যেই রাখতাম না, বরং আমার বয়সী ভাইবোনদেরও বিজ্ঞের মতো তা বলতাম। ওরাও আমার মতোই সেই বিশ্বাস নিয়ে রাজ্যের তিতা খাবারগুলো খেত। কিন্তু প্রায় প্রায়ই আমাদের এই বিশ্বাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেত যখন দেখা যেত বছর জুড়ে কম-বেশী এইসব বাজে খাবার খেতে হচ্ছে।
এরপর দিন সকাল থেকেই তোরজোড় শুরু হতো। বড় বড় হাঁড়িতে পোলাও আর গরুর মাংস রান্না হতো। পারিবারিক সদস্য, বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজন ও কাজের লোকজন মিলিয়ে ৬০ জন মানুষের রান্না। প্রায় প্রতিদিন ও প্রতিবেলাই এ আয়োজন লেগেই থাকতো। আমাদের ছোটদের কাছে বিশেষ কিছু মনে হতো না। রান্না হয়ে গেলে পাড়ার বাড়ি বাড়ি আমরা ছোটরা গিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম। পোলাও মাংস রান্না হতে হতে বিভিন্ন দোকান থেকে বিশেষ খাবার চলে আসতো, যেমন, নীপেন কাকার মিষ্টির দোকান থেকে বড় ঠোঙ্গায় ভরে ছোট ছোট চমচম ও সিঙ্গাড়া, গোপাল বাবুর বেকারি থেকে কাঠালপাতা ও বাঁশ দিয়ে বানানো ঝুড়িতে শুকনা বুন্দিয়া, লাড্ডু ও বিরাট বিরাট নিমকি, সিঙ্গাড়া হাউস থেকে ছোট ছোট সিঙ্গাড়া আর কালোজাম।
যে কর্মচারীরা দিতে আসতো, তারা বলতো “হালখাতা‘র মিষ্টিগো বুড়ী, ভেতরে নিয়া যাও আর তোমার আব্বাকে বলো যে, গোপালবাবু পাঠাইসেন”। আমি হালখাতা বুঝতাম, নববর্ষ বুঝতাম না। এইসব খাবার দাবার আমার কাছের স্বপ্নের মতো মনে হতো।
মনে হতো আগের দিনের তিতা খাওয়া যে কতো কাজে লেগেছে, এখন থেকে সারা বছর আর তিতা খেতে হবে না। সেই স্বপ্নময় খাবার খেয়ে আমরা মোটামুটি বোঝাই হয়ে থাকতাম, তাই পোলাওটা বা মাংসটা আর সেভাবে খাওয়া হতো না, বা তার জন্য আপসোসও হতো না। এইদিন আমরা ছোটরা ড্রইং খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কাঁচা হাতে রং পেন্সিল দিয়ে “শুভ নববর্ষ” লিখে চারদিকে লতাপাতা, হাঁস, মুরগী, কবুতর, কাকসহ নানান শিল্পকর্ম করে তা ভাত টিপেটিপে পেছনে লাগিয়ে দেয়ালে সেঁটে দিতাম। আমাদের ছোটদের কাঁচি ও আঠা ধরা নিষেধ ছিল। টেরাবেকা কাগজ আর জটিল শিল্পকর্মের চাপে কাগজটি মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছাতো, সাথে ভাতের আঠা অচিরেই শুঁকিয়ে গিয়ে দেয়াল থেকে চুন সমেত খসে পড়তো। আমরা আবার থুতু দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তা দেয়ালে আটকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে একসময় খান্ত দিতাম।
বিকাল হতে হতে পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠ থেকে ভাওয়াইয়া গানের সুর ভেসে আসতো। সেখানে ছোটখাটো একটা মেলার মতো আসর বসতো। তবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে বৈশাখী মেলাটা বসতো কালেক্ট্ররেট মাঠে। বিকেলে আমরা সেই মেলায় যেতাম। ২ টাকা দিয়ে মাটির সিংহ, বাঘ, মহিষ, হাঁস এদের পিঠে চড়ে (দেশীয় মারিগো রাউন্ড) বোঁ বোঁ করে ঘুরতাম আর মনে হতো বুক ছিঁড়ে এবার নির্ঘাত কলিজাটা বেরিয়ে আসবে।
এরপর উঠতাম কাঠের নাগরদোলায়। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ছন্দে ছন্দে সেটা ওপর থেকে নীচে নেমে আসত, আবার ওপরে চলে যেত। ওখান থেকে নেমে ডুগডুগি, বেলুনওয়ালা বাঁশী পোঁ পোঁ করে বাজাতে বাজাতে আর ঠোঙ্গা ভরে বাতাসা, কদমা ও চিনির ঘোড়া, হাতি, হাঁস, মোরগ কিনে খেতে খেতে ফিরতাম বাড়ীতে এবং ততোক্ষণে মুখের ভেতরে ছাল ছিলে যেত।
বাড়ি ফিরে সেদিন পড়ালেখার তেমন কোন চাপ থাকতো না। শুধু সেদিনই না, বরং সারা বন্ধ জুড়েই পড়ালেখার আহামরি কোন চাপ থাকতো না। সারাদিন প্রচুর খেলাধুলা করে রাতে একটু-আধটু বই নিয়ে বসলেই ইস্কুলে দেয়া বাড়ির পড়া হয়ে যেত। আসলে শুধু খেলাধুলা না করে পড়ালেখার সাথে যেন ন্যূনতম সখ্যতাটা ছেলেমেয়েদের থাকে সে পরিমাণ বাড়ির পড়াই শিক্ষকরা দিতেন।
এখন ভাবলে স্বপ্ন মনে হয়। নববর্ষের দিন পড়ালেখার বিষয়ে কেউ কোন চাপাচাপি করতো না, চাপটা শুধু থাকতো ম্যাট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থীদের জন্য।
আজকের এই পান্তা ইলিশের নববর্ষ আমাকে ঠিক টানে না। আমি মনে মনে ফিরে যাই সেই গোপালবাবু, নীপেন কাকার হালখাতাতে। যে হালখাতার দিনে কেউ সাদা-লালের জামা বা আনুষ্ঠানিক পান্তা ইলিশের কথা বলে না, যে নববর্ষটি অনেক বেশী অনানুষ্ঠানিক, তবে বিশুদ্ধ আনন্দে ভরপুর।
সবাইকে নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। মঙ্গলময় ও কল্যাণকর হোক সবার জীবন, এ কামনা রইল সবার জন্য।