লীনা হাসিনা হক: চিত্র এক, ঢাকা বিমানবন্দর, ৬ এপ্রিল, ২০১৫, সকাল সাড়ে ১১টা। বিমান বাংলাদেশের কাউন্টারের সামনে তিনটি বিশাল লাইন- ঢাকা টু রোম, কাঠমান্ডু, দুবাই, সব চেক ইন একসাথে হচ্ছে। বিজনেস ক্লাসের আলাদা কাউন্টার! আমি সামান্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের আরও সামান্য কর্মী, ইকনমি ক্লাসের কাউন্টারের লাইনে জনা তিরিশেক যাত্রীর পিছনে দাঁড়িয়ে।
বিজনেস ক্লাসের কাউন্টারে বিমানের যে কর্মকর্তা কাজ করছিলেন আমাকে ইশারা করলেন সেই কাউন্টারে যেতে, খুব সম্ভবত আমার নেহায়েত গোবেচারা চেহারা দেখে তাঁর মায়া হয়েছিল। আমার চেক-ইন মাত্র শুরু হয়েছে, মিনমিন করে একটা জানালার পাশের সিটের জন্য অনুরোধ করছি সেই মুহূর্তে হুড়মুড় করে বিশাল দেহী একজন নারী আরও জনা কয়েক সাথে নিয়ে আমার প্রায় গায়ের উপর দিয়ে তাঁদের পাসপোর্ট টিকিট কাউন্টারে রেখে বেশ চড়া গলায় বললেন, এগুলো আগে করেন!
বিমানের কর্মকর্তাটি বিনয়ী হেসে বললেন এই ম্যাডামেরটি শেষ করেই করছি। নারী যাত্রী ধমকের সুরে বললেন, আমাদেরটা আগে করেন! আমি এইবার তাকিয়ে বললাম, আপা, আমার সুটকেস চলে গেছে লাগেজ বেল্টে, আমারটা হতে আর বেশী সময় লাগবে না, আর আমাদেরকে রেখে বিমান উড়বে না!
কঠিন সুরে নারী বললেন, আপনি কে? বিজনেস ক্লাসে যাচ্ছেন? উত্তরে জানালাম, আমি কেউ না, নেহায়েতই এক ইকনমি ক্লাসের যাত্রী, উনারা দয়া করে আগে ডেকেছেন। ব্যাজার মুখে তিনি তাঁর সহযাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভিআইপিদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা কেন রাখে না! এইবার কৌতূহলী হয়ে বললাম, আপা, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে! ( মোটেও না!)
উনি আরও ব্যাজার মুখে নিজের নাম বললেন- ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য তিনি, সংরক্ষিত নারী আসনে! নেপালে যাচ্ছেন- সরকারী টাকায়- বেসরকারী ভাবে! মনে মনে ভাবছিলাম আমার দেয়া করের টাকার একটি অংশও তো এই মহান কাজে ব্যয় হচ্ছে!!!
চিত্র দুই- ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টার, দুপুর ১২টা, এপ্রিল ৬, ২০১৫
আমার চেক ইন শেষ। দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশনের লাইনে। বিশাল লাইন। সেখানে বাংলাদেশী পাসপোর্ট, প্রবাসী বাংলাদেশী, সার্ক দেশ এবং বিদেশী পাসপোর্টের আলাদা কাউন্টার। বিদেশীদের জন্য কাউন্টার খালি, কর্মরত অফিসার আমাকে হাত ইশারায় ডাকলেন। খুব সম্ভবত আমার চেহারার মধ্যেই সদ্য গ্রাম থেকে আসা নিরুপায় ধরনের কিছু আছে হয়তো- তাই সবখানেই এই ধরনের সহায়তা পাই মোটামুটি।
যাচ্ছি সেইদিকে, আমার পিছনে দাঁড়ানো একজন নারী, প্রিন্টের বোরখা পড়া, কাঁধে ব্যাগ, হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে এক ফাইল ধরা, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপা, দুবাই যাব, কি করবো এখন? নারীটি গৃহশ্রমিকের কাজ নিয়ে দুবাই যাচ্ছেন। নরসিংদীর গ্রামে বাড়ী। স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছে, দুটো সন্তান নিয়ে তিনি বাপের বাড়ীতে থাকেন, সরকারী এই সুযোগটি কিভাবে কিভাবে পেয়ে সন্তানদের মায়ের কাছে রেখে যাচ্ছেন দুই বছরের জন্য।
তাঁকে সাথে নিয়েই গেলাম কাউন্টারে, ইমিগ্রেশন অফিসারকে অনুরোধ করলাম যাতে এই শ্রমিক নারীটির ইমিগ্রেশনের কাজটি আমার সাথে সাথেই করে দেন উনি। অফিসার ভালো মানুষ, শ্রমিক নারীর কাগজপত্র দেখতে শুরু করলেন, আমিও দাঁড়িয়ে সেখানে।
বেশ শোরগোল আমাদের পেছনে, তাকিয়ে দেখি সেই সংসদ সদস্য অত্যন্ত কঠিন গলায় কিছু বলছেন, আর জনা তিনেক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর সামনে কাঁচুমাচু হয়ে কি বোঝাচ্ছেন!
এক পুলিশ এসে ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললেন, ভাই, ভিআইপি যাত্রীদেরটা আগে করে দেন। ইমিগ্রেশন অফিসার জানালেন, সম্ভব নয় এখন, কারণ তিনি ইতোমধ্যেই নারী শ্রমিকের ইনফরমেশন ডাটাবেজে দিতে শুরু করেছেন, মাঝপথে বন্ধ করা সম্ভব নয়!
আমিও একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ভিআইপিরা সাধারণ যাত্রীদের লাইনে আসেনই বা কেন!! এরই মধ্যে সংসদ সদস্য চলে এসেছেন কাউন্টারের সামনে, এসেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কে বলেন তো? তখন থেকে দেখছি বড় বড় কথা বলছেন!
হেসে বললাম, আমি নিয়মিত করদাতা সাধারণ এক যাত্রী! নারী শ্রমিকটির দিকে অবহেলার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এ কে? আমি জানালাম, উনিও তেমন কেউ না আসলে, তবে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো মজবুত রাখতে উনি গৃহশ্রমিক হিসাবে দুবাই যাচ্ছেন যাতে সেখান থেকে টাকা পাঠিয়ে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বছরে ১৮ শতাংশ থেকে আরও বাড়ে! একমাত্র আমাদের দেশেই এনাদেরকে কোন ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হয় না, শ্রীলংকা, ফিলিপিন্স, এমনকি পড়শি নেপাল পর্যন্ত তাঁদের জন্য আলাদা কাউনটার রাখে!
সংসদ সদস্য কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, সত্যযুগ হলে ভস্ম হয়ে যেতে দেরী হতো না সেই দৃষ্টিবাণে, কলিযুগ বলেই বেঁচে গেলাম!
মনে মনে বললাম, আর এঁদের টাকাতেই আপনাদের ভিআইপি মর্যাদা বজায় থাকে!!!