আয়শা আক্তার কণা: দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কাঁধে না আসা পর্যন্ত আসলে কোনভাবেই বোঝা সম্ভব না যে, সেটি আসলে কত ভয়ানক। আমাদের এই সমাজ মেয়েদের প্রতি অনেক অনেক বৈষম্য করে, খুব ঠিক। কিন্তু পুরুষের প্রতিও যে করে আসছে, সেটি খুব কমই শুনেছি! তাছাড়া নিজে কেন জানি আগে ওদিকটাতে তেমন মন দিতাম না।
শুধু নিজের কষ্টটা নিয়েই ছিলাম… একপেশে ভাবেই… কেন! তাও জানিনা।
তবে হ্যাঁ, ক্রমশ নিজের কথা আর কাজের মিল ঘটাতে গিয়ে, নিজে যখন একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে সার্বিকভাবে দেখতে চাইলাম, যখন এই “পরিবারের সকল সদস্যের দায়-দায়িত্ব একমাত্র পুরুষের” জিনিসটাতে নিজেকে লিন করতে চাইলাম (একজন মানুষ হিসেবে) তখনই একটু একটু করে টের পেতে শুরু করলাম!
ভাবনায়ও পরিবর্তন আসলো আমূল। আজ বুঝি, এটি অনেক কঠিন একটি কাজ। মানসিক ও শারীরিক দুভাবেই। নিজে নিজে একে একে সব দায়িত্বের স্বাদ পেয়েই বিশেষ করে বুঝেছি, কি ভয়ংকর বৈষম্য এই সমাজ পুরুষের সাথেও করে আসছে। এবং সেটাও সেই কোমলমতি মনের ছোট্ট শিশুবেলা থেকেই! আমার ছোট্ট রূপাই’ও ওই দলে দলেই চলেছে… এই ধারাবাহিকতায় আমার মেয়ে শিশুটি হতে শিখছে পরনির্ভরশীল; সক্ষম যে সহজেই হতে পারে তাকে আরেকভাবে অকেজো করে মানসিকভাবে একটি বোঝা হিসেবে গড়ে তুলছি; অথবা অন্তর্ভুক্ত করছি আরেক ধরনের স্বীকৃতিহীন কাজে। কি ভয়ানক অহেতুক বৈষম্য সৃষ্টি নারীদের প্রতিও।
…….ফলাফল
অনেক মানবিক নারী ও পুরুষের জন্ম…
অনেক অমানবিক নারী ও পুরুষের জন্ম।
…..আমি এও দেখেছি আমার কিছু ভীষণ রকমের ভাল পুরুষ ভাই বা বন্ধুকে সারাজীবন ধরে “বিশাল বিশাল অভিজ্ঞতার, বিশাল বিশাল চাহিদার, সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও ভীষণ স্বার্থপর, অন্ধ এক ধরনের সো-কল্ড পরগাছা নারীদের, নীরবে বহন করতে। হাসিমুখে বা দায়িত্ব ভেবে অথবা অন্য কিছু একটা মনে করে হয়তো, যা আমি জানি না, কিন্তু তারা জানেন… কিন্তু করে গেছেন, করে যান এবং যুগ যুগ ধরে করে যাবেনও… মৃত্যুর আগ পর্যন্তই করে যায় তারা।
এই নারীরা, দায়িত্ব শুধু পুরুষের বলে এবং তার নয় ভেবে, আয় করলেও কি অদ্ভুতভাবেই ক্ষমতায়নের মূল অর্থ না বুঝে “আমার টাকা আমার, তোমার টাকাও আমার” করে জীবন চালিয়ে দিচ্ছে… আর দাবী করে যাচ্ছে নিজেকে সচেতন মানুষ/নারী হিসেবে হাস্যকর ভাবেই। যেন অর্থ হাতে রাখা বা বাড়ানোটাই নারী স্বাধীনতা!!
এই এদের জন্যেই আমাদের সেই অনেক পরীশ্রমী, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন, স্বাধীনচেতা সেইসব শ্রদ্ধেয় নারীরা হয় বিতর্কিত সাধারণের কাছে।
সত্যি বলতে কি, আমি বিরক্ত, আমি বিব্রত। আমার এত বছরের ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটা বুঝেছি সেটা কখনোই এমন নয়।
মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাইলে থাকতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর পাশাপাশি হাঁটার মত নির্ভার বন্ধু। নারী ও পুরুষের মাঝে বন্ধুতা। মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখার চোখ তৈরী করতে চাইলে এটলিস্ট নিজের “ভার” আর কারো উপর দিতে নেই। ভার বা বোঝা, নারী বা পুরুষ যেই নেবে সেই হবে উত্তম, যিনি বোঝা, তিনি হবেন অধন… তিনি হবেন পরিত্যাজ্য! সহজ গণিত/ম্যাথ।
আমি যদি কারও উপর ভর করে চলতে চাই সে কতক্ষণই বা হাসি মুখে পারবে বইতে! ধরলাম, তিনি বইলেন তার কমিটমেন্টের জন্য, ছোটবেলার শিক্ষার জন্য, আলু পোড়া খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা চাইলে সমব্যথী হতেও জানতে হবে বৈকি। একজন মরো মরো হয়ে করে যাবেন, আরেকজন সামর্থ্য থাকলেও কাঁধে কাঁধে মিলতে চাইবেন না, সেটাও বা কেমনতরো কথা। নারী কষ্ট করলে পুরুষটি পাশে দাঁড়াবেন, পুরুষ কষ্ট করলে নারীটিও পাশে দাঁড়াবেন…
এমনই হতে হবে।
গাছেরটাও খাবো, তলারটাও কুড়াবো, সেই গুটিকয়েক সো কলড আধুনিক নারী বা পুরুষের ঘুম ভাঙ্গাটা অনেক জরুরি এখন। নইলে কিভাবে সম্ভব! আমার সাফ কথা…
আমাদের লক্ষ্য যদি হয় জেন্ডার বৈষম্য দূর করা, তাহলে দুই পক্ষের বৈষম্যকেই চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে…
দুই পক্ষকেই মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার মূল শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করতে হবে… দুই পক্ষকেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবার সমান সুযোগ দিতে হবে, দু পক্ষকেই তার পছন্দকে বেছে নেবার অধিকার দিতে হবে।
সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষের প্রতি করা সকল বৈষম্য দূর করা….সকলেরটিতেই মনোযোগী হওয়া…
হয়তো আমার কিছু বন্ধুর সাথে এর দ্বিমত আছে… থাকতেই পারে…
কিন্তু এটিও আমার মতামত, একান্তই আমার…
আয়শা আক্তার কণা: উন্নয়নকর্মী
(লেখাটি ৯ নভেম্বর ২০১৪ এর)