শায়লা আহমেদ লোপা: ১৯৯৪ সালের ঘটনা। অনু (ছদ্ম নাম) নামে ময়মনসিংহ শহরে আমার এক বান্ধবী ছিলো। ওদের পরিবার প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক ছিল বংশপরম্পরায়। অনেক ধরনের ব্যবসা। এক সময় খুব যাতায়াত ছিল তাদের বাসায়। মাসি (অনুর মা) খুব আদর করতেন।
একদিন অনু খুব গোপনে আমাকে বললো, তারা বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়েছে, চলে যাবে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কই যাবি? ঢাকা? কারণ আমার মনে হয়েছিল, ওরা তো এখানেই অনেক ভালো আছে, নিশ্চই আরো ভালো থাকার জন্য ঢাকা যাচ্ছে।
অনু কান্না চেপে বললো, না ভারত চলে যাচ্ছি। ভাবলাম, নিশ্চই বেড়াতে। সে হয়ত বুঝেছিল আমি কি ভাবছি, বললো, ‘একেবারেই চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না তোদের সাথে’।
হতভম্ব আমি, সত্যি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিজেদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে ভারত যাবি ক্যান? তুই আবার নতুন বান্ধবী জোগাড় করবি? কী সিলি কোয়েশ্চেন!
যেখানে তাঁদের অস্ত্বিত্বের সংকট, সেখানে আমি চিন্তা করছি নতুন বান্ধবী নিয়ে! বললাম, ওখানে গিয়ে কি করবি, ভালো লাগবে নিজের দেশ ছেড়ে? প্লিজ যাস না। মেসো/মাসীকে বুঝিয়ে বল। তোরা কাকিমাদেরকেও বল প্লিজ। অনু বেশি কিছু বললো না, শুধু জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, নারে, এখানে আর থাকা যাচ্ছে না। বাবা, কাকার অনেক সমস্যা, আমাদের (অনু, দিদি) নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। কি মনে করে আমিও আর কথা বাড়াইনি। অনেকক্ষণ দুই বন্ধু গলাগলি করে কেঁদেছিলাম ।
এখন মাঝে মাঝে ভাবি, কি সমস্যা ছিলো ঠিকমতো জানা হলো না। যদি জানতাম, যদি হেল্প করতে চাইতাম , যদি হেল্প করতে পারতাম। হ্যাঁ, অনেকগুলো যদি —–
মাঝে মাঝে অনুর কথা মনে হয়, সত্যি, আর দেখা হয়নি। হবেও না বোধহয় কোনদিন। চাইলে অবশ্য খুঁজে বের করতে পারি, ওর এক আত্মীয় ঢাকায় থাকেন, তাঁর কাছ থেকেই নম্বর-টম্বর নিতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে হয় না। কি হবে দেখা করে? দেখা হলে হয়তো মনে মনে বলবে, দেখ লোপা, তুই ঠিক থেকে গেলি নিজের দেশে, কারণ, তুই মুসলমান। অথচ আমার চলে আসতে হলো ভিন দেশে, কারণ আমি হিন্দু। অথচ দেশটা তো তোর একলার ছিল না!
নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া খুব কষ্টের, কিন্তু যারা যায় তাঁদের বেশির ভাগ মানুষেরই উপায় থাকে না। তার উপর সেটা যদি হয় জোরপূর্বক, ধর্মের কারণে, সেক্ষেত্রে আর কীইবা বলার থাকতে পারে!
(আজ বন্ধুটার কথা মনে হলো, সে কারণেই লেখা। অন্য কোন কারণ নেই। )