সুপ্রীতি ধর: আজকাল মন খারাপের অনেক বড় বড় কারণ ঘটে, কারও মৃত্যু, কাউকে খুন, সংসার ভাঙার গল্প, কারও আত্মহত্যার খবর, বন্ধুদের ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ের খবর, এসব কিছুই আমাদের বিচলিত করে। সম্প্রতি দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির করুণ মৃত্যু দেখেও আমি/আমরা বিচলিত হই, কষ্ট পাই। কিছুই করতে না পারার অবসাদে ভূগি। ছটফট করি। নিজের দীনতা-হীনতায় নিজেই চুপসে যাই। কীইবা করতে পারি আমি আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা দিয়ে!
মনে পড়ে যায়, আমাদের গ্রামের বাড়িটি একসময় গাছগাছালিতে ভরা ছিল। ঠাকুরমার ঘরের পিছনের কামরাঙা গাছটা সবুজ হয়ে থাকতো টিয়া পাখিতে। কেউ ধরতো না, মারতো না। ওরা নিজের মতো করেই থাকতো। বাড়ির পিছনে বন, শুনেছি, সেখানে বাঘডাসার বাস ছিল। ভয়ে কোনদিন যাইনি। আর এখন? একটা গাছও নেই বড়। আলীশান বাড়ি হয়েছে টিনের বাড়ির বদলে, কিন্তু কাটা হয়ে গেছে সব গাছ। ড্রইং রুম সাজানোর মতোন কিছু গাছ-ফুল গাছ, কলম দেয়া ফলের গাছ ছাড়া পুরো বাড়িটাই হাহাকার কেবল।
আমার সোভিয়েত ইউনিয়নের জীবনেও মন খারাপের কারণ ঘটতো। কিন্তু এখন পিছন ফিরে সেসব দিনের কথা ভাবলে মনে হয়, কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তখন মন খারাপ করেছি। আবার এক ধরনের রোমান্টিকতাও ছিল সেইসব মন খারাপের পিছনে। এক ঘন্টা বাস-মেট্রো-বাস জার্নি শেষে পল্লবদের হোস্টেলে গিয়ে যখন দেখি, আমাকে ছাড়াই তারা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, গা থেকে ওভারকোটটা না খুলেই ত্বরিৎ গতিতে ইউ-টার্ন নিয়ে দৌড়ে চলে আসি লিফটের কাছে, ‘এমন অপমান আর সইবো না’ ভাবখানা এমন। ফিরেই যাবো নিজ রুমে।
‘তোমাদের মতোন বন্ধু না থাকলে কী আসে যায় জীবনে!’ কিন্তু আমি চাইলে কী আর সব হয়? ওরাও পিছু নেয়, টেনে ধরে ব্যাগ, রীতিমতোন ধ্বস্তাধ্বস্তি লিফটের সামনে। শেষপর্যন্ত বন্ধুদের আড্ডায় যোগ দেয়া এবং সারারাত না ঘুমিয়ে দিনভর বেঘোরে ঘুমানো।
এমনও হয়েছে, খুব খিদে নিয়ে গেছি দেশি কারও হোস্টেলে, সেখানে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড, রান্নাবান্না চলছে, গিজ গিজ করছে লোকজনে, কেবল আমিই নেই। নিজেকে অনাহুত মনে করে পেটের খিদে পেটে নিয়েই মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফিরে আসি নিজ হোস্টেলে। ততক্ষণে রাগ গলে জল হয়ে গেছে। আবার ওভারকোট চাপাই শরীরে। আবারও মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সারা শরীরে মেখে ফিরে আসি বন্ধুমহলে। পেট ভরে খেয়ে, গান-বাজনা করে রাত একটায় শেষ মেট্রো ধরে ঘরে ফিরি।
তবে সবদিন সমান যেতো না। কোন কোনদিন অভিমান বা মনোকষ্ট খুবই তাড়িত করতো। ফিন উপসাগরের তীরেই আমার হোস্টেল। টলোমলো মন নিয়ে উপসাগর তীরের কোনো পাথরের ওপর গিয়ে বসে গাংচিলের আনাগোণা দেখতাম। শীতের দেশ বলে গাংচিলরাও খুব একটা সময় আসতো না। মাঝে মাঝে তাদের দেখা মিলতো। শীতের দেশের এই সাগরে ঢেউ ছিল না। আমার মতোনই তখন স্থবির মন নিয়ে পড়ে থাকতো সাগরও। মাঝে মাঝে ছোটবেলার মতো পাথরনুড়ি কুড়িয়ে সেই বদ্ধ জলে ঢেউ তুলতাম। তাকিয়ে থাকতাম সেই ঢেউয়ের মিলিয়ে যাওয়ার দিকে। আমাকে টেনে নিতো তখন ময়মনসিংহ জেলার ছোট্ট, শান্ত শহর গৌরীপুরে আমাদের বাসার সামনের পুকুরে।
ছোটবেলায় এই পুকুরেই কত দাপাদাপি, একটু বড়বেলায় বর্ষাকালে ভরা যৌবন হয়ে যেত পুকুরটির। তখনও সেখানে ঘাটলা ছিল। আমরা দূর থেকে দৌড়ে গিয়ে ডিগবাজি খেয়ে পড়তাম জলে। গুনতাম কয়টা ডিগবাজি খেলাম, দুইটা, নাকি তিনটা। বাসার সামনে ছিল সজনে আর খেঁজুর গাছ। সজনে গাছটা এমনভাবে পুকুরের ওপরে ছিল যে, অনায়াসে আমরা দুরন্ত ছেলেমেয়েরা বেয়ে উঠে যেতাম ওপরে, আর সেখান থেকে ‘সুজন-সখী- বলে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়তাম। মনে আছে, এক বছর সেই পুকুর ইজারা নিয়েছিল রহমান নামের একজন। এমন তার ভাষা, এমন তার গালি যে, আস্তে আস্তে আমাদের পুকুরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সজনে গাছটাও কেটে ফেলা হলো আমার দুরন্তপনার কারণে।
ফিন উপসাগর তীরে বসে এসব কথা ভাবি, আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
তখন আমাদের মোবাইল ফোন ছিল না। উঠে গিয়ে সামনেই পোস্ট অফিস। প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নিই, মায়ের চিঠি এলো কিনা। যেদিন চিঠি পেতাম, সেদিন আমার কী যে আনন্দ হতো। আমরা ২২ দিন পর চিঠি পেতাম দেশ থেকে। বুকের জলে, চোখের জলে একাকার করে সেই চিঠি পড়তাম আরেকটা না পাওয়া পর্যন্ত, বন্ধুদেরও পড়ে শোনাতাম। এমনকি বন্ধুদের মা-বাবার চিঠিও পড়তাম। মাকে বলতাম, মা, তুমি প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখবে, তাহলেই তো আমি প্রতিদিন একটা করে চিঠি পাই। মা হাসতো সেকথা শুনে। একটা চিঠি পাঠাতে তখন কত যেন লাগতো, ঠিক মনে নেই। ২২ টাকা মনে হয়। সেটা তো সম্ভব ছিল না আমার মায়ের জন্য। তাছাড়া প্রতিদিন পোস্ট অফিসে গিয়ে সেই চিঠি পোস্ট করাও কম ঝক্কির ছিল না। তারপরও মা আমার চেষ্টা করতো, কি করে এতোদূরে থাকা তার ছোট মেয়েটাকে একটুখানি ভাল রাখা যায়।
আজ এপ্রিলের ৮ তারিখ, সময়টা ২০১৫ সাল। আর আমি বলছি সেই ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যবর্তী সময়কার কথা। আজও আমার মন খারাপ। আর আটদিন পরই, অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল মায়ের চলে যাওয়ার দিন। পাঁচ বছর হয়ে গেল দেখতে দেখতে। মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা। রান্না করে গুছিয়ে রাখছিলাম মায়ের কাছে যাবো বলে, সারাটা দিন থাকবো সেখানে। হয়নি। তার আগেই খবর আসে, মা নেই আর। হাতের কাজ ফেলে দিয়ে সেই যে দৌড়ে গিয়েছিলাম, আজও যেন পড়েই আছে সব কাজ আমার। কানে ভাসে, মা আর নেই। মা চলে গেছে।
অথচ সোভিয়েত জীবনে দূরে থাকার সময় আমার একটাই কামনা ছিল, মা যেন কখনও আমাকে ছেড়ে না যায়, গেলেও আমার একটা মেয়ে হওয়ার পরই যেন যায়। ঈশ্বর আছে কি নেই, জানি না। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে। আমার মেয়ে হয়েছে, আমি তাকে মা ডেকেছি। তারও অনেক পরেই আমার মা চলে গেছেন। তারপরও কেন জানি, মা আসলে মা-ই।
সোভিয়েত জীবনে কষ্ট ছিল, আনন্দ ছিল তার চেয়ে শতগুণ বেশি। এমন নির্বিঘ্ন জীবনে আনন্দ না এসে পারে! একবার একটা নদীর বোয়াল পেয়ে গেলাম কিভাবে যেন, কাজেই এর সেলিব্রেশন তো মাস্ট। কি করা! সামনেই ২৭ সেপ্টেম্বর, আমার প্রিয় বাবুর (ভাতিজা) জন্মদিন, কাজেই বন্ধুদের খবর দেয়া হলো, এবার আমরা বোয়াল মাছ দিয়ে জন্মদিন পালন করবো। যেই কথা সেই কাজ। ছাই নেই সে দেশে। তাই আটাই ভরসা। আটা দিয়ে মেখে সেই মাছ অনেক কসরত করে কাটা হলো। কেক বানালাম নিজেই। কালজিরা ফোঁড়ন দিয়ে রান্না হলো সেই মাছ, আহ, এখনও মুখে লেগে আছে। জব্বর আড্ডা হয়ে গেল। তো, এমন উপলক্ষ আমরা প্রায়ই খুজেঁ বের করতাম।
মস্কো থেকে কেউ এসেছে লেনিনগ্রাদে বেড়াতে। আসলে গ্রীষ্মকালটা এমনই হতো আমাদের। কেউ না কেউ আসতোই অন্য শহর থেকে। একসাথে দিনভর ঘুরে বেড়ানো, এই মিউজিয়াম থেকে ওই আর্ট সেন্টার, এই উপশহর, সেই উপশহর করতে করতেই কয়েকটা দিন চলে যেতো। ছুটির সময়টা কোনদিক দিয়ে যে বেরিয়ে যেত, টেরই পেতাম না।
আমার ইউনিভার্সিটিতে আমি একাই বাংলাদেশি ছিলাম। আর ছিল বেশ কয়েকজন ভারতীয় বন্ধু। তাদের মধ্যে বাঙালীও ছিল। আর বিভিন্ন দেশের রুমমেট তো ছিলই। সব মিলিয়ে আমার হোস্টেল জীবন ছিল জমজমাট।
তারপরও শীতের দেশে যখন বরফঢাকা সকাল হতো, বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠতো, একটা না পাওয়ার কষ্ট, কোথাও কাউকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট যেন অনুভব করতাম। ঠিক বুঝতাম না আমার এই হাহাকার কার জন্য, কীসের জন্য! কিন্তু হতো! এখনও বরফঢাকা কোন দেশের ছবি দেখলে মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমি নিরিবিলি জায়গা খুঁজতাম, মনে হতো, একাই যদি থাকতে পারতাম সারাটা জীবন! কে জানতো, মনের এমন ইচ্ছে সত্যি হয়ে যাবে! জীবনভর একাই থেকে যেতে হবে! সব থেকেও কিছুই থাকবে না আমার জন্যে! দিনশেষে ঘরে ফিরে দেখবো, কেউ আমার জন্যে অপেক্ষায় বসে নেই! মুখটা পাংশুটে দেখে, কেউ জিজ্ঞ্যেসও করবে না আমায়, ‘কী হয়েছে তোমার, মুখটা এতো মলিন কেন’! কে জানতো! কিন্তু সবই তো চাওয়ার মতোনই হয়ে গেল জীবনে।
আজ থেকে সেই অনেক অনেক বছর আগে যে মেয়েটা একটা চমৎকার বিশ্বে বাস করে এসেছে, সে কী কখনও ভেবেছিল, এতো বছর পর এসে তাকে হতাশায় ভূগতে হবে? ভাবেনি। জীবন পাল্টে গেছে, পাল্টে দিয়েছে সব। তখনকার সেই মেয়েটির ভিতরেও হতাশা ছিল, অনেক কিছু না পাওয়ার কষ্ট ছিল, একাত্তরে বাবাকে হারিয়ে একাকি বড় হতে থাকা মেয়েটির মানসিক অবস্থার কথা কেউ কোনদিন ভাবেনি, কাউন্সেলিং তো দূরে থাক। তাই অনুকূল বিষয়কেও সহজেই সে প্রতিকূল করে তুলেছে শুধুমাত্র মানসিক স্থিরতার অভাবে। এমন কত একাত্তর প্রজন্ম যে আছে, যারা আমারই মতোন হতাশায় ভূগছে, কে জানে! কে কার খবর রাখে!
আজকের পরিণত বয়সের মেয়েটিও একইরকমভাবে হতাশাগ্রস্ত। এখন না পাওয়ার তালিকা অনেক দীর্ঘ হয়েছে। যা সোভিয়েত জীবনের প্রাপ্তিকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন এখানে যুদ্ধ চলছে। স্পষ্ট করে কথা বলতে না পারার যুদ্ধ, ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মানসিক যুদ্ধ, সামাজিক যুদ্ধ, রাজনৈতিক যুদ্ধ তো বিশ্বজুড়েই।
মুখরা মেয়েটির তাই জায়গা হয় না কোথাও। (চলবে)