সারিতা আহমেদ: দুটি ঘটনা। প্রথমটি একটা রাজ্যে, অন্যটি দেশে। একটির ভিক্টিম ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া কিছু নারী, অন্যটির ভিক্টিম খোদ HRD Minister ( মানব সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী ) শ্রীমতি স্মৃতি ইরানী । দুই ঘটনায় মিল কোথায় ?— দুটিই নারী নিরাপত্তার প্রশ্নে একটা বড়সড় থাপ্পড় !
আসুন দেখা যাক—-
১) “Naming and Shaming,
Victims in Sexual Violence !”
এই শিরোনামে স্যানিটারি প্যাডে স্লোগান লিখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের নোটিশ বোর্ডে সাঁটিয়ে দেয় কিছু ‘কলরবি’ ছাত্রছাত্রী । হ্যাঁ , ওদের ‘ভিসি হঠাও-ধর্ষণকাণ্ডের দ্রুত বিচার চাই ‘ আন্দোলনের পরে এখন ওই নামেই ডাকা হয় ।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৭ শে মার্চ , শুক্রবার। দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাড-প্রতিবাদ কাণ্ড থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নারীদের ক্রমাগত শ্লীলতাহানি, ক্যাম্পাসে মেয়েদের ইভটিজিং করা, সমাজে চলা লিঙ্গবৈষম্য, ঋতুস্রাব নিয়ে অযথা গোপনীয়তার বিরুদ্ধে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে ও ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে একটা জোরেশোরে প্রতিবাদ করার লক্ষ্যে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা এই অভিনব প্যাড প্রতিবাদ অভিযান শুরু করে ।
যারা নেপথ্যে রয়েছেন তারা এই ঘটনার কোনোকিছুই গোপন করেননি। খোলাখুলি স্বীকার করেছনে তাদের এজেন্ডা।
অরুমিতা মিত্র নামে এক ছাত্রী জানান , ‘এই ধরনের প্রতিবাদ সংঘটিত করার জন্য ইতিমধ্যেই ‘পিরিয়ডস’ নামে একটি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ কি ভাবছেন, কি করবে না করবেন তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। ভবিষ্যতেও এমন প্রতিবাদে আমাদের সংগঠন থাকবে ও লড়বে।’
এরপর থেকেই এই প্যাড নিয়ে প্রতিবাদের ঘটনা ছড়িয়ে দেয় আগুন। যারা যারা আগের ‘ভিসি হঠাও’ আন্দোলনকে সমর্থন করছিলেন, সেই ওয়েবকুপা/আবুটা শিক্ষক সমিতি বা নানারঙ্গের ছাত্র সঙ্ঘরা আজ কলরবি প্রতিবাদীদের দুয়ো দিচ্ছে , কেউ আবার একদম মৌন ব্রত নিয়েছে। তাদের মতে, দাবী বা প্রতিবাদ জানানোর অনেক পথ আছে, কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে কোনটা শোভনীয়। স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে প্রতিবাদ এদেশের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না । উপাচার্য থেকে শিক্ষক মহল এই নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত। তাঁরা বলছেন ‘এমন প্রতিবাদ যা মেয়েদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তা কিছুতেই মানা যায় না ।’
আবার ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী অমিত ভট্টাচার্য বলেন, তাঁর এটাকে ন্যায্য প্রতিবাদের পথ হিসেবে মানতে আপত্তি নেই । তিনি বলেন, ” সব প্রতিবাদের পদ্ধতি সবার মনমতো নাও হতে পারে , কিন্তু মানুষের ভাবনাকে একটা ধাক্কা দিতে এধরনের পদ্ধতি কিন্তু প্রয়োগ করা হতেই পারে । আর ছাত্ররাই তো তাদের প্রতিবাদের উদ্ভাবনী শক্তি দেখাবে , তাই না ?”
২) ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’ ভারতের একটি জনপ্রিয় মার্ট বা শপিং মল । নানা রাজ্যে নানা সিটিতে এই মার্টের ব্রাঞ্চ আছে । তেমনই এক ব্রাঞ্চে ড্রেস কিনতে গিয়েছিলেন ভারতের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী শ্রীমতি স্মৃতি ইরানী । ড্রেস পছন্দের পরে ট্রায়াল রুমে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন সেখানে একটি হিডেন ক্যামেরা আছে । সঙ্গে সঙ্গে তিনি ম্যানেজারকে খবর দেন , শোকজ করা হয় দোকানের মালিককে। চার্জ করা হয় দোকানের সব কর্মচারিদের । যদিও দোকানের কেউই এই অভিযোগ মানতে রাজী নন । কিন্তু তদন্তে জানা যায় সেই মার্টের একজন কর্মী লুকিয়ে মেয়েদের ড্রেসিং চেঞ্জের সময় মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও তোলার দোষে এর আগেও দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, শাস্তিও পেয়েছে। কিন্তু কোনো পুলিশকেস তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়নি। এসব কিছু নিয়ে এখন কেন্দ্রীয় সরকারি স্তরে তদন্ত কমিশন বসেছে, উত্তাল রাজনীতি ও জনগণ মহল।
“কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরই যদি কোনো সুরক্ষা না থাকে তাহলে এদেশের বাকি সাধারন মেয়েদের কী অবস্থা !”- এরম মন্তব্য ‘ক্লীশে’ শোনালেও বাজারে আবার ছড়াচ্ছে ।
এখন দেখা যাক, এই দুই ঘটনায় মোদ্দা কথা কি ?
কিছুই না , ওই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় !নারীর কোনো সুরক্ষিত দেশ নেই , রাজ্য নেই, জায়গা নেই, ঘর নেই, ক্যাম্পাস নেই, শিক্ষাঙ্গন নেই । কিচ্ছু নেই । স্যানিটারি ন্যাপকিন দোকানে কিনতে গেলে দোকানি প্যাড দেওয়ার আগে খবরের কাগজ খোঁজে তা আড়াল করতে । তাড়াহুড়ায় বড্ড বিচ্ছিরি লাগে এই ওয়েট করা । আমার এরম অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভিড় ওষুধের দোকানে চেঁচিয়ে “ও দাদা , হুইস্পার আল্ট্রা আছে ? একটা দিন তো ।” বলতেই দোকানি মেপে নিল। তারপর ইশারায় স্টাফদের কিছু বলল। তারা আগে একটি খবরের কাগজ খুঁজতে লাগল। আমায় ওয়েট করতে ইশারা করা হলো। ক্রেতার ভীড়ে মন দিলেন দোকানি। আমার ধৈর্য্য জিনিসটা বরাবর ভীষণ কম। এতক্ষন ধরে প্যাড কেনার ধৈর্য্য রাখা দায় ।
“ছাড়ুন তো। কাগজে প্যাক করতে হবে না। আমার ব্যাগ আছে। মালটা দিন, দামটা নিন।” দোকানী থেকে ক্রেতার ভিড় এবার ফুল্টু আমার দিকে মুভ! যেন কী এক নিষিদ্ধ কথা আমি বেফাঁস বলে ফেলেছি । লজ্জায় ওদেরই লাল হতে দেখলাম। আমি তখন বাড়িমুখো। সে যাক, এখানে আমার প্যাঁচালি বলতে আসিনি।
বলছিলাম, আমাদের সভ্য সংস্কৃতির কথা । ওই যে শিক্ষককূল বলছিলেন, স্যানিটারি প্যাড নিয়ে প্রতিবাদ করাটা মেয়েদের অস্বস্তিতে ফেলবে । শুধু তাই না, এটা ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে মেলে না । এক্কেবারে অসভ্য একটি নির্লজ্জতা ! তো আমার প্রশ্ন , রেপ করাটা বা গোপনে মেয়েদের নগ্ন ছবি নেওয়াটা আমাদের ‘পশ’ সভ্যতার কত নং ধারায় / উপধারায় আছে ?
আচ্ছা, নাহয় ধরে নিলাম, সব পুরুষ , ‘পুরুষ’ নয় তাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ ।তারা ‘সদা সত্যং বদ’ পাঠ করে , সকল মেয়েদের ভগিনী সমান দেখে , রেপ করার চিন্তা মাথা থেকে যোজন
দূরে রাখে এবং ভারতীয় সভ্যতার ধারক বাহক হিসেবে বেশ গর্ব বোধ করে ।
এখন কথা হল, এরাও কি সানী লিওনকে একটু বাঁকা চোখে দেখে না ? তাঁর মেয়ে রাতে বাড়ি ফিরতে না পারলে সকালে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস না করে মেয়ের মাকে তার পোষাক তছনছ করে একটু তল্লাশি চালাতে বলেন না ?নাকি এগুলো সবই সভ্যতার পরাকাষ্ঠা !
স্যানিটারি প্যাড কিনতে গেলে কাগজের ঢাকনা চাপা লাগে ,
মেয়েদের বাইরে বেরোতে হলে বোরখা বা হিজাবের ঢাকনা লাগে ,
সী-বিচে বেড়ানোর সময়ও মেয়েদের বুকে আলাদা একটা ঢাকনা দেওয়া লাগে,
পোষাক কিনতে গেলে ট্রায়াল রুম মার্কা একটা আলাদা ঢাকনা ঘর লাগে ।
তো এইসব ঢাকনা কি ফেমিনাইন জেন্ডার ?
মেয়েদের জন্যই এগুলোর সৃষ্টি কিজন্য এই প্রশ্নটার উত্তর দেবে কোন সুশীল বুদ্ধিজীবি ?
উল্টোদিকে, ছেলেদের কনডম কেনার সময় প্যাকেট কাগজের ঢাকনা চাপা লাগে না। জাপানী তেলের ক্ষেত্রেও একই কথা । কারন ওটা থেকে ‘মেল’ ‘মেল’ গন্ধ আসে ।
ওগুলো কেনা মানেই উদ্ধত পুরুষালি ঘোষণা দেওয়া ‘look, I am able to have sex or fun with someone , may be ‘ size ‘ matters , but I or my partner don’t care .”
তো মেয়েদের প্যাড কেনাও তো একইভাবে ফেমিনিষ্টিক উচ্চারণ করে, “See, I am able to give birth of a baby . I may not have wish to do so, but I can .”তাহলে এবেলায় এত রাখঢাক গুড়গুড়ে ঢাকনা চাপা কেন ? প্রতিবাদে যদি পুরুষ তার বুকের উপর লিখতে পারে , ” Do Or Die !” বা আণ্ডার ওয়্যারের স্ট্রিপে লিখতে পারে “Justice delayed is Justice denied .” ইত্যাদি, এবং সেগুলো দিব্বি ‘অ্যাংগ্রী ইয়ং ম্যান ‘/ ‘মাচো ইমেজের’ বিপ্লবী প্রতীক হয়ে উঠতে পারে ,
তাহলে মেয়েরা তাদের নিজস্ব ভঙ্গীতে ব্রা’র উপরে, প্যান্টির উপরে, প্যাডের উপরে কিছু লিখে প্রতিবাদ জানায় সেটা কোন ধারায় অপরাধী তালিকাভুক্ত হবে? ওহ, তার মানে এদেশের, ম্যান মেড কৃষ্টি অনুযায়ী ‘প্রতিবাদ’ শব্দটিও জেন্ডার বায়াসড, বড্ড পুং !
মন্ত্রী স্মৃতি ইরানীই যদি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাহলে আমরা কোথায় যাই — বলছেন যারা তারা বোধহয় ভুলে গেছেন উনি মন্ত্রী হতে পারেন কিন্তু আগে নারী। আর নারী মাত্রেই সে ভগিনী নন … ভোগের সামগ্রী ।
তাই যে ক্যামেরা আম-মেয়েদের জন্য ফিট করা হয়েছিল তাইই উনাকেও ট্র্যাপ করতে চেয়েছে । ক্যামেরা তো আর অত ‘ভিআইপী প্রোটোকল’ বোঝে না ! তো এবার যদি এই ঘটনা নিয়ে অন্য কোনো নারী সংগঠন , মহিলা সমিতি প্যাড নিয়ে মিছিল করে তাহলে কেমন হবে ?
ভারতীয় কৃষ্টির ইতিহাসে মহিলাদের ফলো করা,
টিজ করা, অপমান করা,
তাদের শারিরীক গঠনের অসভ্য ভাবে সুযোগ নেওয়া , যেখানে সেখানে উত্তক্ত করা,
অটোতে-বাসেতে ইচ্ছেকৃত কনুইয়ের গুঁতোয় শরীরের সাথে ঘেষে বসে অর্গাজমের সুখ পাওয়া ,
স্যানিটারি প্যাডের অ্যাডে ‘লালী মাসিকে দেখাচ্ছে ‘ বলে সিটি বাজানো —এসবই ‘ম্যান মেড’ নিয়মের মধ্যে পড়ে । কারণ এগুলো সব বড্ড মেয়েলী !
ওকে, ফাইন । এরা যদি সব মেয়েদের জিনিস হয় তাহলে এগুলো নিয়ে মেয়েরা পথে নামলে তোমাদের মুখ -মাথা ‘শীঘ্রপতনের’ মত তোম্বা হয়ে যায় কেন , হে ?
‘পুরুষের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ’ — স্লোগান যেমন তোমাদের কানে বড্ড মধুর শোনায় ।
তেমনি ‘মেয়েদের রক্ত লজ্জায় আরক্ত’ — শুনলে আমাদের কানে শলাকা হয়ে বিঁধে যায় ।
এই রক্তের কারণে তোরা পৃথিবীর আলো দেখেছিস, এই রক্ত থেকেই পুষ্টিরস শোষন করে মায়ের জঠরে ক্ষুধা নিবারণ করেছিস। আর এখন এই রক্তই তোদের চোখ টাটায় !
হিডেন ক্যামেরা ফিট করে আদুর গায়ের মেয়ে দেখতে যদি তোদের ভালো লাগে, প্যান্টের ভিতর সুরসুরে এক সুখ নামে। ‘আরো চাই , আরো চাই ‘ বলে ভেতরটা যদি হাহাকার করে ওঠে;তাহলে মেয়েদের ব্যবহৃত ন্যাপকিনে প্রতিবাদি লেখা দেখেও তেমনি ভালো লাগাতে হবে ।
আফটার অল, মেয়েলী জিনিস তো পুরুষের লোভনীয়, কমনীয় বস্তু। এই নিয়ম তো পুরুষই বানিয়েছে ।
তাহলে মেয়েদের এই জিনিস নিয়ে মিছিল, স্লোগান , নোটিশবোর্ডের দম্ভ দেখতে কেন এত চোখ কড়কড় করছে ???
যাদবপুর এমন অনেক প্রথভাঙ্গা প্রতিবাদীদের পিঠস্থান দেখতে আমার ভালো লাগছে।
ভালো লাগছে এটা ভেবেও যে এদের অনেকেই আমার বন্ধুস্থানীয়।
ভালো লাগছে এই ‘নেই রাজ্যের’ একজন বাসিন্দা হতে পেরে।
ভাল লাগছে প্রতিবাদিদের পাশে দাঁড়াতে পেরে।
ভালো লাগছে আমার দেশের আমার জন্মস্থানের বেশ কিছু ফেলো সিটিজেন এমন ট্যাবু ভাঙ্গা বিপ্লব বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন বলে।
ভালো লাগছে ‘পিরিয়ডস’ ফোরামের নেক্সট এজেন্ডাগুলোও এমন আরো অনেক কিছু নতুন সৃজন করতে পারবে বলে।
লাল সেলাম ‘পিরিয়ডস ‘ … অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমাদের জন্য ।
তোমরা হয়তো স্মৃতি ইরানী নও, কিন্তু সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। এখন শুধু দাবানল হওয়ার অপেক্ষা …সেই লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে এগিয়ে চল। পাশে আছি।