মায়াবতী কোচ একজন সফল আদিবাসী কৃষক  

1উইমেন চ্যাপ্টার: মায়াবতী কোচের বয়স ৪৬। বাড়ি রাংটিয়া গ্রামে। জায়গাটি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের রাংটিয়া গ্রামটি ভারত সীমানার পূর্ব পশ্চিম বরাবর। কোচ আদিবাসীরাই এই গ্রামের আদিম অধিবাসী। এই গ্রামে কোচদের বেঁচে থাকার সংগ্রামও দীর্ঘ এবং বেদনাঘন।  খুব বেশিদিন আগের কথা না, যখন এই এলাকাটি ছিল ঘন অরণ্যে ঘেরা। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবজগত এবং পরিবেশ ছিল সেখানে। স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং জীবন ধারায় কোচরা তখন নানা বৈচিত্র্যে এবং প্রাকৃতিক জ্ঞানের ধারক ছিল। প্রাকৃতিক আবাস ভূমি বনেই ছিল তাদের অবাধ বিচরণ।

নাম :  মায়াবতী কোচ
স্বামীর নাম :  মনেন্দ্র  কোচ
বয়স :   ৪৬  বছর
উৎপাদিত ফসল :  লাউ, মিষ্টিকুমড়া, লাল শাক, টমেটো, মূলা  ইত্যাদি
কৃষি জমির পরিমাণ :  ১.৫০ একর
অঞ্চল : রাংটিয়া, শেরপুর
সহযোগিতাকারী সংগঠন : সোসাইটি ফর বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন

কোচদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের অস্তিত্ব জমি এবং বনের সাথে রয়েছে আত্মিক ও অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক। অবৈধ দখলদারদের হাতে সামাজিক বনায়নের নামে বনবিভাগের মাধ্যমে যখন এই কোচদের আবাসস্থল বেহাত হতে শুরু করে তখন টনক নড়ে স্থানীয়দের। কিন্তু তাতে লাভ হয় না খুব একটা, আজ কোচ আদিবাসীরাও নিজেদের শতাব্দী প্রাচীন আবাসভূমিতে অবৈধ দখলদার।

নিজস্ব জীবনধারায় বন থেকে নানান লতাগুল্ম – জঙ্গলি আলু, শাকপাতা, ফলমূল কুড়িয়ে হরেক রকমের খাবার তৈরি করা হতো এবং এই সব খাবারের উপকরণ প্রকৃতিতেই থেকেই জন্ম হতো। স্থানীয় জ্ঞান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এইসব সম্পদ সংরক্ষণ, আহরণ ও সনাক্তকরণে কোচ আদিবাসীদের ভূমিকাই ছিল মূখ্য। এক সময় দুবেলা খাবারের চিন্তা করতে হয়নি এখানকার মানুষের। নিজেরাই নিজেদের তৈরি পোশাক পরতেন। প্রাকৃতিক উপায়ে নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করতেন।

কিন্তু দেশের অন্যান্য এলাকার মত রাংটিয়া গ্রামের কৃষিতেও একসময় পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। আধুনিক কৃষির নামে শুরু হয় পরিবেশবান্ধব কৃষির ধ্বংসযজ্ঞ। টিকে থাকার তাগিদে সকলেই অবতীর্ণ হয় আরও বেশি ফসল উৎপাদনের প্রতিযোগিতায়। রাসায়নিক কৃষির কাছে পারাজিত হয় জৈব কৃষি। ফলে ঠিকে থাকতে পারেনি কোচদের ঐতিহ্যবাহী সনাতনী কৃষি ব্যবস্থা।

2মায়াবতী নিজের দেড় একর জমিতে এবং অন্যের জমিতে কাজ করে অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা করিয়েছেন। বড় ছেলে সুশান্ত কোচকে (২৩) ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স পাশ করিয়েছেন, দ্বিতীয় মেয়েকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। আর তৃতীয় মেয়ে এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। নিজে টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি বলে একটা খেদ চিরকালই ছিল মায়াবতীর, তাই ছেলেমেয়েদের মুর্খ রাখতে চাননি।

কৃষি আর দিনমজুরি করেই দিন চলে তার। কিন্তু সমস্যা হলো একজন সার্বক্ষণিক কৃষক হওয়া সত্ত্বেও সমাজে কেউ তাকে নারী কৃষক বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না। স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় তাকেই সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ অন্যান্য সব খরচ বহন করতে হয়। জমির কাজ করতে হয়। জমির যেটুকু ধান উৎপন্ন হয় তা দিয়ে সবার চলে না। প্রতিবছরই ঋণ করতে হয়। ঋণের ভারে এখন দিশেহারা মায়াবতী কোচ। একদিকে পাঁচজনের ভরনপোষণ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা, ফসলের জন্য সার-বীজ কেনা, অন্যদিকে মহাজনী ঋণ। উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি, অভাব নিত্য সঙ্গী।

সরকার বিনা পয়সায় সারবীজ দিচ্ছে লোকমুখে এ খবর পেয়ে কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদে, এমনকি উপজেলা পরিষদেও ধর্না দিয়েছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। সরকারের কোন সুযোগ-সুবিধা পাইনি। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কৃষি ঋণ দেয়, এমন বিষয়টিও তিনি জানেন না।

নিজের হাতে রোয়া লাগান, সার-বীজ দেন, নিড়ানি দেন, ধান কাটেন, আবার ধান মাড়াইও করেন নিজেই। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি একাই করেন। মাঝে মাঝে মেয়ে তাকে সাহায্য করে। এখানেই শেষ না, পোষায় না বলে নিজের জমির কাজ শেষ করার পর অন্যের জমিতে প্রায়ই দিনমজুর হিসেবে কাজ করে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করেন। আবার যখন কৃষিকাজ থাকে না তখন নিজেই বাড়িতে বাঁশ দিয়ে ধান রাখার ডোল, কুলা, পাটি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে নিজেই মাথায় করে বিক্রি করতে নিয়ে যান। এছাড়াও বসত ভিটার আশেপাশে শীতকালে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, লাল শাক, টমেটো, মূলা চাষ করেন। শাকসবজি বাগান করার কারণে এখন মায়াবতীর সংসারে অনেকটা সাশ্রয় হয়। দু-ফসলি দেড় একর জমি থেকে বছরে ৬০ মন  ধান পান। চাষাবাদ এবং সার বীজের খরচ বাদ দিয়ে ৪০ মন ধান তার থাকে। এই ৪০ মন ধানই খাওয়ার জন্য বরাদ্দ।

মায়াবতী জানান, প্রতিমাসে ছেলের পড়াশোনার খরচ বাবদ ৪০০০ টাকা, মেয়ের জন্য ১২০০ টাকা, স্বামীর চিকিৎসা এবং বাজার খরচ বাবদ ২০০০ টাকাসহ মোট ৭২০০ টাকা মাসে ব্যয় হয়। দিনমজুরি, ডোল, কুলা, চালনা, পাটি বিক্রি করে এবং মহাজনের কাছ থেকে ঋণের এই সমস্ত টাকা সংগ্রহের জন্য নির্ভর করতে হয়।

মায়াবতীর কাছে এসব কাজ এখন আর কঠিন মনে হয় না। উপরন্তু বেশ সাচ্ছন্দ্যই বোধ করেন। তাছাড়া সামাজিকভাবেও কোনো বাধার শিকার তিনি হননি। শুধুমাত্র বাজারে মহাজন অথবা দালালদের কাছে ডোল, কুলা, চালনা, পাটি বিক্রি  করার সময় মাঝে মধ্যেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।  তিনি জানান, তার সম্প্রদায়ে তিনি একাই নন, তার মতো অনেক আদিবাসী নারীই তার মতোন কৃষিকাজ করেন। তিনি এখন অনুসরণযোগ্য অনেকের কাছে। অনেকে কৃষি কাজ করার পাশাপাশি কুটির শিল্পের কাজও করে থাকেন।

বাংলাদেশে মাত্র দুটো উপজেলায় দুই থেকে আড়াই হাজার কোচ আদিবাসী রয়েছে। মায়াবতীর ভাষায়, ‘আমরা আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতিসহ বর্তমান পরিচয় হারাতে বসেছি। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং আমাদের জন্য সাহায্য বা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই কেবল, এই দেশে এবং বিশ্বের মানচিত্রে কোচ আদিবাসী হিসেবে টিকে থাকতে পারবো।’

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.