মৌলবাদ ও বাংলাদেশ

OLYMPUS DIGITAL CAMERA
ছবিটি লেখক মঈনুস সুলতানের কাছ থেকে নেয়া

হাসিনা আকতার নিগার: ইংরেজি Fundamentalism এর বাংলা অর্থ হলো মৌলবাদ। বাংলায় এর শাব্দিক ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘ধর্ম শাস্ত্রের প্রতি অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাস।’ মৌলবাদ শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো মূল জাত। সহজ কথায় মৌলবাদ বা মৌলবাদী তাকেই বলা যায় যে একটি মৌলিক ধারণা বা বিশ্বাসকে সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করে।

ধর্মকে এখানে মূল শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ বিশ্বের সূচনালগ্ন বা আদিকাল থেকে মূল জাত বিষয়টি ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। আর সে ধর্ম হলো খ্রিস্টধর্ম। ওয়েবস্টার অভিধান অনুসারে মৌলবাদ বা মৌলবাদিতা হচ্ছে একটি আন্দোলন। যা আমেরিকার প্রটেস্ট্যান্ট কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে শুরু হয়। এই আন্দোলন ছিল আধুনিকতার বিরুদ্ধে এবং উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বাস, নৈতিকতা ও ইতিহাস হিসেবে বাইবেলকে সত্য এবং চিরন্তন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখা। এই আন্দোলনে বাইবেলকে স্রষ্টা থেকে আগত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চেয়েছিল। আর এ আন্দোলন ছিল বাইবেল বা খ্রিস্ট ধর্মানুসারী একদল মানুষের, যারা কোনো যুক্তি বা ব্যাখ্যা দ্বারা পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বাইবেলের বাণীকে বিশ্লেষণ করতে চাইতেন না। কেননা তারা বাইবেলকে সকল ভুলের ঊর্ধ্বে স্রষ্টার থেকে সরাসরি প্রাপ্ত বাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চেয়েছিলেন।

অক্সফোর্ডের অভিধান অনুসারে মৌলবাদ বলতে বুঝায় প্রাচীন কোনো ধর্ম বা কোনো বিশ্বাসকে দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করাকে। তবে আক্ষরিকভাবে মৌলবাদকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন একটি কথা সর্বজনস্বীকৃত যে বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে একদল মৌলবাদী সকল সময় ছিল, এমনকি এখনো আছে। আর এ মৌলবাদীদের অজ্ঞতা বা অন্ধবিশ্বাসকে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তিরা ব্যবহার করেছে কিংবা এখনো করছে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পরিধিকে বিস্তৃত করার উদ্দেশে।

একটা সময় মৌলবাদকে পুঁজিবাদীরা ব্যবহার করেছে সামন্তবাদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে। আবার দেখা গেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে কোনো কোনো দেশে মৌলবাদ উসকে দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এটাও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মূলত পুঁজিবাদীরা পূর্বে যেমন মৌলবাদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে গণতন্ত্রের নামে বা সমাজতান্ত্রিক নীতিকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে।

আবার এখন অর্থনৈতিক সহায়তার নামে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে থেকে মৌলবাদের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে নানাভাবে। যেখানে বর্তমান বিশ্বে অল্পসংখ্যক দেশ ছাড়াই অধিকাংশ দেশ উদার ধর্মপন্থী।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘মৌলবাদ’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোখে ভেসে ওঠে মুসলমান ব্যক্তি ও ইসলাম ধর্ম। আর যে বিষয়টি  মুসলমানদের অনেক বেশি জন্য লজ্জাকর তা হলো, পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিমদের জন্য এটা এক ধরনের গালি। কেননা মৌলবাদ ও মুসলমান শব্দটির চিত্রায়ন হয় একজন সন্ত্রাসী, বোমা হামলকারী বা হত্যাকারীর চরিত্রে।

এক কথায় বলা হয় মৌলবাদী বা জঙ্গি। অথচ জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দুটি শব্দ যে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) মুসলমানদের জন্য ধর্মের যে শাশ্বত বাণী রেখে গেছেন তা হলো-  ‘বিনা কারণে কোনো বিধর্মীকেও হত্যা করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।`
সাংবিধানিকভাবে ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মানুষ একে অন্যের ধর্মের প্রতি সহনশীল। তথাপি কতিপয় ধর্মীয় উগ্রবাদীর নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে এদেশে জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু এদেশের জনগণ কোনোদিনই তা সমর্থন করেনি বা করে না বলে আজ অবধি এসব জঙ্গিবাদের উত্থান সূচনাপাতের আগেই যবনিকা টেনেছে। উদাহরণ স্বরূপ হলো, বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি।

ইসলামিক দেশগুলোতে ইসলামের মধ্যে যে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাধারা আছে, তা থেকে তাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে জোরেশোরে। যার নাম হলো ধর্মান্ধতা। এর ফলে দেখা যায় যে, পাকিস্তানে বোমা পড়ছে, আফগানিস্তানে সন্ত্রাস চরম আকার ধারণ করেছে।  বস্তুত সন্ত্রাসবাদের নামে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যারা চেষ্টা করছে, তারা ইসলাম বলতে যে জিনিসটা বুঝে, সেটাকে বলা যায় উগ্রপন্থী বা রিজিট। তারা ইসলামিক চিন্তা-ভাবনাকে নানাভাবে অপব্যাখ্যা করে জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যার ফলে সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান ও ইসলাম ধর্মানুসারী। কিন্তু এখানে কিছু সংখ্যক মুসলমান আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করার কথা তুলে সন্ত্রাস করছে, মানুষ হত্যা করছে, প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা করছে। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাস সৃষ্টি হচ্ছে তার কারণ আজ অবধি জনগণের কাছে পরিষ্কার না হলেও বেশ কিছু ঘটনার পর একটা বিষয় পরিষ্কার, এই ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ উত্থানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমানে জঙ্গিবাদ বেড়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জঙ্গিবাদের ধরনের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। বিশ বছর আগের জঙ্গিবাদ এবং এখনকার জঙ্গিবাদের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সন্ত্রাসের জোগানদাতা বা ইন্ধনদাতা হিসেবে অনেক সময়ই কাজ করে রাজনৈতিক শক্তি। রাজনৈতিকভাবে এ সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য অর্থ, পেশিশক্তি বা অন্য আরেকটি সন্ত্রাসের বা জঙ্গিবাদের সহায়তায় সমাধানের চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক যে শক্তি সে শক্তি এ ধরনের জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করছে, সমর্থন করছে ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে ।

প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে সরকারি দল বা বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা করে তাহলে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হতো তা হয়তো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে।

বস্তুত জঙ্গিবাদের বা সন্ত্রাসবাদের মতো এতো বড় সমস্যাকে মোকাবেলা করা একা সরকারের পক্ষে সম্ভব না। এজন্য বিরোধী দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমন্বয় লাগবে, কিন্তু বাংলাদেশে এ সমন্বয় নেই। বিগত ১৫/১৬ বছর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে এই সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটা দেখতে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং জঙ্গিবাদ মোকাবেলা ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যর্থতা একটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.