অভিনন্দন মডারেট মৌলবাদ! বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম!

Nari n Religionশারমিন শামস্: যথেষ্ট সময়ের অপচয় হয়েছে। অবশেষে মেনে নিলাম, এইসব ছাইপাশ বিচার চাওয়া, মুক্তি চাওয়া, বাঁচতে চাওয়া- এ সবই অর্থহীন। নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের দায়ে আরো একজনকে ঝকঝকে দিনের আলোয় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।  ‘এর বিচার চাই’ বলে সময় নষ্ট করার কোন অর্থ হয় না।

এরই মধ্যে চারপাশে ‘‘বাবু যা লিখেছে, তাও অন্যায়, বাবুর উচিত হয় নাই এসব লেখা, ধর্ম তোমার ভালো নাই লাগতে পারে, তাই বলে এইসব…’’ ইত্যাদি প্রভৃতি মন্তব্য আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। অতএব বিচার সবার আগে হচ্ছে বাবুর। যারা খুন করেছে, যারা ব্লগ কী না জেনেই একটা মানুষকে বীভৎসভাবে কেটে শেষে করে দিলো চাপাতির আঘাতে, তাদের পক্ষে চেতনে-অবচেতনে এরইমধ্যে মাঠে নেমে গেছে বহুজনে।  অর্থাৎ খুনটি তাদের দৃষ্টিতে যেকোন ভাবেই হোক, জায়েজ। ঠিক যেরকম অভিজিৎ রায় হত্যার পর ঘটেছিল।

এদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের অভাব নেই।  নামাজ পড়ুক না পড়ুক, সত্য বলুক না বলুক, রোজা রাখুক না রাখুক, কোরবানির দিনে আস্ত গরুর উপরে ছুরি নিয়ে ঝঁপিয়ে পড়তে পারে তারা।  ওই ঝাঁপিয়ে পড়াটুকুই অনেকের কাছে ধর্ম।
এদেশে অভাব নেই ঘুষখোরের। অভাব নেই দুর্নীতবাজের। অভাব নেই মিথ্যুকের।  তারা সবাই চায় শান্তি। কেন বাবা তুমি এইসব লিখতে গেছো? কেন অভিজিৎ তুমি এতসব গবেষণা করতে গেলে? কেন হুমায়ূন আজাদ এত সব কথা ফাঁস করতে গেলেন? এইতো বেশ ছিলাম আমরা। নিজের জীবনে জগতে, দুর্নীতি, অসততা, মিথ্যা আর নোংরামিকে যত্নে ঢেকে রেখে। এই তো বেশ আছি। ওরা ইসলামী শাসন চায়, চাক না। ওরা মাদ্রাসা শিক্ষা চায়। হিজাব করাতে চায়, করাক।

এতো কেন বাবা ঝামেলায় জড়াও! হোক, বাংলাদেশ হোক মৌলবাদী। এই কর্পোরেট দুনিয়ায় মৌলবাদও হবে কর্পোরেট মৌলবাদ, মডারেট। সো, নো চিন্তা ভাইয়েরা, বোনেরা। ঠিক ঐ ফিনফিনে শাড়িওয়ালির মাথায় ঝলমলে চুড়ো করে বাঁধা হিজাবের মত। নিচেও আছে উপরেও আছে। দুই দিক রক্ষা।  এমনই হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাছে শো শো করে।

কেন বাবারা ঝামেলা পাকাও বুঝি  না। তোমরা এইসব লেখা টেখা বাদ দাও।  কী বললে? বিশ্বের সব উন্নত দেশেই লেখকের লেখার স্বাধীনতা আছে? লেখকের লেখার জবাব দেয়া হয় লেখা দিয়েই?

না বাবা! আমরা অন্যরকম। আমরা বিশ্বের বিস্ময়! আমরা বাংলাদেশের মডারেট মৌলবাদী। আমরা এত কিছু বুঝি না। তোমার মনে কী আসলো না আসলো, তা মনেই রেখে দিতে হবে। ঝামেলা পাকাবা না। রোজা রেখে মিথ্যা বলা, আর কুরবানির গরু নিয়ে ছবি তোলা- এই আমাদের ধর্মপ্রাণ চেহারা। এই নিয়ে বেশ আছি। কেন আবার এতো সব লেখালেখি! লিখতে হবে না। আরে বাবা, পড়ালেখা না করেই তো গাদাগাদা জিপিএ ফাইভ। ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, মাদ্রাসা, নালন্দা, ছায়ানট- কত্তরকম প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে! এগুলি সব এক জায়গায় মিলেমিশে এক- ভাইবারে, স্কাইপে, ফেসবুকে, সেলফিতে, কেএফসিতে।

মোটকথা, কর্পোরেট এই দুনিয়ায় ইসলামকে আমরা আমাদের মত করে গুছিয়ে নিয়েছি।, এতে দোষের কিছু নেই। এদেশের রাজনীতিও আমাদের সমর্থনে আছে। অতএব, এটাই চলবে। ওইসব লেখা ফেখা বাদ।

আমাদের সালমান রুশদীর কোন দরকার নেই। হুমায়ূন আজাদটা আবার কে? সে জন্মেছিল কেন এই দেশে? তাকে কে বলেছে এতো এতো পড়াশোনা করতে? কে বলেছিল অভিজিৎকে এতো জানতে, ভাবতে? আমরা মডারেট মৌলবাদী। অন্তত আমি আজ থেকে তাই। আর কিচ্ছু শুনতে চাই না। এতো সময় নেই।  আমরা কানে তুলো দিয়ে চোখ বেঁধে বসে থাকবো। মুখ থাকবে বন্ধ। একদম এরকম। যদি এর মধ্যে কেউ আমাদের মত না হয়, হয় অন্যরকম, ভাবে যদি অন্যভাবে, তবে তার মৃত্যুর দায় তারই।

বলতে পারো, উচিৎ সাজাই হবে তার। যারা ওকে হত্যা করবে, তারা কী চেতনা কী ভাবনা কী জ্ঞান কী প্রজ্ঞা ধারণ করে এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটালো, তা দেখার প্রয়োজন বোধ করবো না। এই সমাজে এইসব লেখালেখি এইসব চিন্তা গবেষণা চলবে না। সবাইকে হতে হবে এক মতের এক পথের দিশারী। যদি না পারো, তো মর। এর দায় তোমার। মৌলবাদের জয় হউক। মৌলবাদেই শান্তি, নিশ্চিন্তি।

আজ থেকে আমি মৌলবাদী, মানে মডারেট আর কি! সবই করবো, পার্টি করবো, মদ গিলবো, যত্রতত্র সেক্স করবো সুবিধা দিতে বা নিতে, আবার ধর্মও করবো এবং অবশ্যই অবশ্যই যারা লিখবে, মানে আরকি প্রেমের কবিতা গল্প বা উপন্যাসের বাইরে, যারা বলবে, মানছি না, বুঝছি না, খটকা লাগছে, তাদেরকে প্রয়োজন নেই। তারা অপ্রয়োজনীয়। অতএব চাপাতির কোপ পড়লে, তা আজ থেকে জায়েজ।

না, মাননীয় সরকার, আপনাদের আর কষ্ট করে ঘাম ঝরিয়ে হুকুমদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে না। কয়েকদিন পরেই আমাদের নেতা নিজেই আসবেন প্রকাশ্যে, তার অমিয় বাণী সাথে নিয়ে। অপেক্ষায় থাকুন একটু। সবুরে মেওয়া ফলে।

লেখক- সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.