এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ

Crocodile tearsফারহানা আনন্দময়ী:  নিজেদের নির্বিকার নির্লিপ্ততায় আমরা আতংকের গিরিখাদ তৈরি করবো আর বলতেই থাকবো জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ নয়, তা কী করে হবে? এই প্রতিবাদহীনতা তো আজকের নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ‘ও আই সি’র সদস্যপদ পাওয়ার জন্যে কী তোড়জোড়… ‘আমরা সবাই বাঙ্গালি’র স্থপতি বঙ্গবন্ধু সেদিন আনন্দে গদগদ হয়ে বাঙালি মুসলমান হলেন। ’৭৫ এ যেদিন সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো… ‘বাংলাদেশি’রা যেন বিশ্ব জয় করলো।

স্বৈরাচার এরশাদ যেদিন পবিত্র সংবিধানে রাষ্ট্রের একটা ধর্মীয় পরিচয় খোদাই ক’রে দিলো… সেদিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কতজন রাজপথে নেমেছিলেন এর প্রতিবাদে? এভাবেই হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে এগিয়েছে মৌলবাদীরা তাঁদের গন্তব্যের দিকে। এই তো সেদিন হাটহাজারীর মাদ্রাসায় শফি মোল্লার কাছে বর্তে যাওয়া ভঙ্গীতে দোয়া নিতে যান ডিজিটাল বাংলাদেশের সম্মানিত মন্ত্রী। এভাবেই সাধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ধর্মান্ধ মৌলবাদের কাছে নতজানু হ’তে হ’তে আজ মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, চাপাতির কোপে রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে।

এই বাংলাদেশে পৌঁছে আজ একজন মুক্তমনা লেখক তাঁর মুক্ত মতপ্রকাশের জন্যে মৌলবাদীদের চাপাতির কোপ খাবেন… এতে এতো অবাক হওয়ারই বা কী আছে, শুধু ফেসবুকে ঝড় উঠিয়ে প্রতিবাদেরই বা কী আছে? নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আমরা ক’জনে নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের মানসিক গঠন এভাবে তৈরী করেছি যে কোনোরকম মুক্তমত, প্রধাবিরোধী বিশ্বাস সহজ চিত্তে গ্রহণ করতে পারি ? ধারণ করার প্রশ্ন তো অনেক পরের। যারা মুক্তচিন্তা করছে তাঁদেরকে বুঝতে হবে, আমাদের মগজটা এখনো অতোটা পরিণত হয়নি, প্রথাবিরোধী বিশ্বাসকে সহ্য করার মত উপযোগীও নয়। কেন আপনারা ভুল ক্ষেত্রে আপনাদের শ্রম দেবেন? কেনই বা নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবেন?

থামুন… এটা সেই বাংলাদেশ, গতকাল বিবিসি’তে ওয়াশিকুর বাবু’র হত্যাকাণ্ডের নিউজে এই বাংলাদেশের নাগরিকেরা মন্তব্য করছেন, “ হ্যাঁ, উনি তো নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বালছাল লিখে, বিবিসি তো আর খবর খুঁজে পায় না, তাই এই খবর ছেপেছে”। ওখানের মন্তব্যের ভেতরে এটাই সবচেয়ে শালীন মন্তব্য, বুঝে নিন অন্য মন্তব্য কী হতে পারে। অনলাইন ছেয়ে গেছে নারীবাদের পক্ষে দীপিকা পাডুকোনের এক ভিডিওতে… ভীষণ সাহসী, দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক। গতকাল এ দেশের একটা প্রথম সারির পত্রিকা সেটা নিউজ হিসেবে ছেপেছে, ইতিবাচক দৃষ্টিতে।

হ্যাঁ, এটা সেই বাংলাদেশ… ওখানে যদি ৯৯% ভাগ মানুষের মন্তব্য পড়েন, হিসেবটা অনেক সহজ হয়ে যাবে কেন বাংলাদেশের মাটিতে একজন হুমায়ূন আজাদ, একজন অভিজিৎ রায়ের কোপ খাওয়াকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হতে হবে। সেইসব মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ধর্মতন্ত্র এবং পুরুষতন্ত্র মানুষকে কতটা অমানুষ করে তুলতে পারে।

মুক্তমত প্রকাশের জন্যেও যেমন, মুক্তমত শোনার জন্যেও, পড়ার জন্যেও একটা আধুনিক মনন থাকা জরুরি। অশিক্ষিত মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম, শিক্ষিত সংস্কৃতিবান ক’জন মানুষের এটা আছে? তারা বেশীরভাগই আজ পর্যন্ত আধুনিক পোশাককেই সহজ দৃষ্টিতে দেখতে পারেন না, সেখানে আধুনিক বোধকে কীভাবে সহজভাবে দেখবেন?

না, আমি এটাও বলছিনা, যে আধুনিক পোশাক পড়লেই সে মননেও আধুনিক হবে… তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই হয়। আজকাল কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে নিজেকে এলিয়েন মনে হয়, চারপাশের দৃষ্টি এমন জিজ্ঞাসু থাকে। বাংলাদেশ যে চিন্তা চেতনায় পেছন পথে হাটছে রাস্তায় বেরোলে বেশ টের পাই… প্রতি দশজন নারীর আটজন হিজাব নামক এক বিজাতীয় পোশাকে আবৃত। অথচ ২/৪ বছর আগেও এই পোশাকে থাকা কোনো নারীকে আশেপাশে দেখলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিটা তার দিকেই যেত… আজ বড্ড স্বাভাবিক। তো একটুও অবাক হবেন না, এই বাংলাদেশের মাটিতে আরো কয়েকজন মুক্তমনা লেখককে দিনের আলোয় খুন হতে দেখে। কারণ ক্ষেত্রটা আমরাই তৈরী ক’রে দিয়েছি।

একটা আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার জন্যে কী দরকার ছিল প্রথম থেকেই… শিক্ষা। পারিনি আমরা একধারার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে মাদ্রাসা রাষ্ট্রের মদদে। যেখানে প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি উপজেলায় পাঠাগার গড়ে তোলার কথা সেখানে আমরা মডেল মসজিদ বানানোর প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। জানালাটা যদি এভাবেই শুরুতেই বন্ধ ক’রে দিই, মুক্তভাবনার আলো বাতাস ঢুকবে কোন দিক দিয়ে ? শুরুটা হতে হয় শুরু থেকেই, গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালতে ঢালতে যদি বলি মুক্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই… কী ক’রে হবে ? যতদিন দেশের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন না হবে, ততদিন কারো সাধ্য নেই এই চাপাতিবাজদেরকে প্রতিরোধ করার।

খুব ব্যক্তিগত একটি বিষয় দিয়ে শেষ টানি। আমার দুই সন্তানকে যখন ছোট্টবেলায় একটি মিশনারী স্কুলে ভর্তি করলাম, আশেপাশের চেনা মানুষেরা সাবধান করলেন, ওখানে তো বাইবেল পড়ায়, ওই স্কুলে বাচ্চাদেরকে ভর্তি কোরো না। কেন, ওরা খ্রীষ্টান হয়ে যাবে সেই ভয় পাচ্ছো, আমি বললাম। আজ আমার মেয়ে ওই স্কুল থেকেই গ্রাজুয়েশনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে… ও কিন্তু খ্রীস্টান হয়নি, বরং অনেক বেশি মানবিক হয়েছে। ও প্রশ্ন করতে শিখেছে, ও প্রশ্নহীন কিছু মানতে নারাজী হতে শিখেছে। রামুতে পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাওয়ার অপেক্ষা না ক’রে নিজের জন্মদিনে পাওয়া টাকার থেকে নির্দ্বিধায় হাজার টাকা সাহায্যবাক্সে দিতে পারার মত মানবিক হয়েছে আমার ছেলেটা। যেদিন মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্রে সন্তানদের স্বাক্ষর প্রয়োজন হলো, ওরা সই ক’রেই দুজনেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা, I feel proud of you. আমরাও একদিন।“

ঘর থেকেই শুরু করেছিলাম… একটু একটু ক’রে মুক্তচিন্তা করার ক্ষেত্রটা তৈরী করে দিতে চেয়েছি নিজের সন্তানদের জন্যে… কিছুটা তো পেরেছি। আমার জয় ওখানেই… লড়াই আরো বাকী। সকলেই যদি শুরু থেকেই শুরু করেন তাহলে আজ অভিজিৎ রায়দের জন্যে আমাদের অক্ষম ক্রোধে ফেটে পড়তে হতো না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো না।

কবিতা লিখবো ব’লে বসেছিলাম… কেঁদে গেলাম এক বুক কান্না।

শেয়ার করুন: