শামীমা মিতু: ‘বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছে, বিচ্ছেদ ঘটানোয় নারীরা এগিয়ে’ পত্রিকার পাতায় সংবাদের এমন হেডিং দেখে কার মনে কি এসেছে জানি না, তবে আমার মনে প্রশ্ন এসেছে
বিয়ে প্রথা কি টিকে থাকবে আগামী শতাব্দীতে?
আমি অবশ্য বিয়ে উঠে যাবার সম্ভাবনা দেখছি। বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধে কিন্তু প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে বাঙ্গালী সমাজে। যতটা না লিভ টুগেদারে, তাঁর চেয়ে বেশি বিয়ে-বিচ্ছেদে। তাই মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরা যতই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠুন না কেন, আমি বলবো ‘বিয়ে’ নামক প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সামনের সময়গুলোতে এই শব্দটাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
আসলে ভালোবাসা হয় সমানে সমানে। আজও যদি বিবাহিত পুরুষেরা বউ-বাচ্চা এবং সম্পত্তির মালিক মনে করে নিজেদের এবং যত্র তত্র মালিকানা ফলাতে চায় তো বিয়ে তো ভাঙ্গবেই। নানা আঙ্গিকেই ভাঙ্গবে। বিয়ের মাঝে যতদিন পুরুষের নিজেদের কর্তৃত্বের আসনে বসে থাকবে, ততদিন মেয়েরা থাকবে কোণঠাসা, তাকবে নির্ভরশীল। মার খাবে, তন্দুরে পুড়বে তারপর বিকল্প খুঁজবে।
প্রতিটি বিয়ের পেছনে রয়েছে দুটি লিঙ্গের সারা জীবনের পরিবেশ। সেই বিয়েতে নারীর জীবনের পুরস্কারটা যদি হয় স্বামী, তো নারীকে তাঁর জন্য উৎসর্গ করতে হয় নিজের নাম, একান্ততা, ব্যাক্তিগত সম্মানবোধ, এমনকি গোটা জীবনটাই।
নারী-পুরুষ সমতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে অনেক নারীই হয়তো একথার সাথে একমত হতে চাইবেন না। কিন্তু তাতে বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এখনো নারী চেতনে, অবচেতনে, নির্বুদ্ধিতায় কিংবা পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে ‘সুখি সংসারের কারিগর’ ভাবতে থাকেন নিজেকে। সুখি সংসারের কারিগর থেকে সুখি মানুষ হতে চাইলেই মুখ থুবড়ে পড়ে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান।
হেনরিক ইবসেন সম্ভবত প্রথম ব্যাক্তি যিনি এই সত্যটি ধরতে পেরেছিলেন। নোরা যখন তাঁর স্বামীকে পরিত্যাগ করে, সবাই ভাবে সে তাঁর দায়-দায়িত্বে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল কিংবা সে নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল।
সে রকম কোনো কারণে নয়, বরং এজন্য যে সে জানতে পারে আট বছর ধরে সে এক অপরিচিতের সাথে ঘর করেছে। তাঁর সন্তান জন্ম দিয়েছে। দুজন অপরিচিতের জীবনভর কাছাকাছি থাকার মতো অপমানজনক, অমর্যাদাকর কি হতে পারে?
আমাদের দেশে অধিকাংশ বিয়েতে এখনো কি সেই অবস্থা বজায় নেই যেখানে পুরুষের আয় ছাড়া কিছুই জানার প্রয়োজন নেই নারীর? আর নারী সম্পর্কে – সে দেখতে সুন্দর এর চেয়ে বেশি কি জানবার আছে?
নারীর কোনো আত্মা নেই, সে পুরুষের অংশ, পুরুষের পাঁজর থেকে বানানো-এমন সব ধর্মীয় রুপকথাকে আমরা এখনো ছাড়িয়ে উঠতে পারিনি।
অবশ্য যে নারীর আত্মা যত কম থাকে স্ত্রী হিসেবে সে তত মূল্যবান, তত দ্রুত সে স্বামীতে বিলীন হবে।
এমা গোল্ডম্যান তাঁর বিবাহ ও প্রেম গ্রন্থে শতাব্দি আগে লিখেছিলেন- ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি দাসসুলভ মৌন সম্মতিই বিবাহ প্রতিষ্ঠানটিকে এত দীর্ঘকাল ধরে অক্ষত রেখেছে’।
কি অদ্ভুত! বিয়েকে কেন্দ্র করে সমাজের চিন্তাভাবনা একুশ শতকে এসেও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। শুধু নারী যখন বেরিয়ে আসছে, প্রভুর কৃপার বাইরে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি ততই দুর্বল হয়ে উঠছে। কোনো আবেগভরা বিলাপই এটাকে ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।
ইউরোপে বিশেষ করে সুইডেনে, সুইজারল্যান্ড ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণীরা একসময় বিয়ের বন্ধনকে অস্বীকার করে একসাথে থাকতে শুরু করেছিল। আবার লিভ টুগেদার করা যুগলদের ছেলেমেয়েরা বিয়ের দিকে ঝুঁকছে। ও দেশে কোনো সন্তানই বেজন্মা নয়। বিয়ে বা না-বিয়ের যে কোনো সন্তানই সে দেশের বৈধ নাগরিক। বাবা-মায়েরা জীবন নিয়ে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করুক, রাষ্ট্র তাঁর ভবিষ্যৎ নাগরিকের সবরকম নিরাপত্তা দেয়।
আদিম সাম্যবাদী সমাজে ব্যাক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করতো আধুনিক রাষ্ট্র তাই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
তবুও কিন্তু বিয়ে উঠে যায়নি, উঠে যাচ্ছে না। আসলে যেখানে কোনোটাই অবৈধ নয়, তখনো মানুষ সব নিয়ম ভেঙ্গে দিতে চায় না। নিয়ম ভাঙ্গা আর নতুন নিয়ম গড়ার এই খেলাটা মানুষ উপভোগ করে। তারপর সংখ্যাগরিষ্টরা বেছে নেয় সময়ের বিচারে নির্ভরযোগ্য এবং স্বস্তিজনক আঙ্গিকটিকে।
বিয়ে যদি সমানে সমানে ভালোবাসার ঘর হয়ে উঠতে পারে, তাহলে হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী টিকে যাবে, নয়তো বিকল্প খুঁজবে মেয়েরা। সেই বিকল্পের নাম হতেই পারে সহবাস, বিবাহহীন দাম্পত্য, লিভ টুগেদার, যেকোনকিছু।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট