এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে, ইহার মাধুরী বাড়াও হে

8 March 3কানিজ আকলিমা সুলতানা: নারী ও পুরুষের প্রীতিপূর্ণ বিকাশে সমাজ দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়। সমাজের মানুষগুলো আস্থা ও আনন্দের সাথে জীবনযাপন করে। ইতিহাস বলে নারীর হাত ধরেই সামাজিক ব্যবস্থাপনা গতি লাভ করেছিল।

রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভলগা থেকে গঙ্গা বইয়ে সেই প্রাচীনকালে নারীর নেতৃত্বে কিভাবে সমাজ গড়ে উঠেছিল তার বিশদ বর্ণনা আছে। শিকার করে আনা পশুর মাংস বিলিবন্টন থেকে গোত্রের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হতো  নারী নেতৃত্বের নির্দেশে। প্রাচীন মিশরে না্রীরা ছিল পুরুষের সঙ্গী ও পরিপূরক। নারীদের ছিল পুরুষের মতো একই অধিকার, বিচারালয়ে ছিলো একই ক্ষমতা। সেখানে নারী উত্তরাধিকারী হতো এবং সম্পত্তির মালিক  হতো। কালের পরিক্রমায় নারী ক্রমশঃ তার ক্ষমতা হারিয়ে পুরবাসিনী হয়েছে।

জমি দখলের লড়াইয়ে  পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে নারীকে প্রজননের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরুষ। এতে পরিবার বলশালী হয়েছে, জমির পর জমি দখল হয়েছে কিন্তু পেষনে, নির্যাতনে নারী ক্রমশঃ হারিয়েছে সংসারে সমাজে তার ন্যূনতম অধিকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাপনায় নারীর অবস্থান একেবারেই যখন তলানীতে তখন ধীরে ধীরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে নারী অধিকার কর্মীরা। সময়ের আবর্তনে সচেতন হয়েছে তারা, সোচ্চার হয়েছে পুরুষের সাথে সম-অধিকারের দাবিতে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদেরকে তাদের অধিকার  থেকে বঞ্চিত রাখতে সমাজে নানা ধরণের প্রচারণা চালাচ্ছে।

তারা মনে করে যে নারীরা পুরুষের ন্যায় সবল নয় এবং  নারীদের বুদ্ধিও কম। ফলে বিচারালয়ে,  মজুরীতে, সম্পত্তিতে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের ন্যায় সম অধিকার ভোগ করতে পারছেনা। প্রচলিত এই ধারণায় সমাজে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে এবং নারী-পুরুষের দ্বন্দে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কেবলই অস্থির হয়ে উঠছে।

আশংকার কথা এই যে, ইতোমধ্যে সাধারণ নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের অধিকার বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ হয়ে আছে, যার ফলে সমঅধিকারের লড়াইয়ে কাংখিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। জীববিজ্ঞানের উপাত্ত অনুসারে বলা হয়ে থাকে যে  পুরুষ শারীরীকভাবে বলশালী ও পুরুষের মগজের আয়তন নারীর থেকে বেশি।

এই উপাত্ত নির্ভর নারী ও পুরুষের সামাজিক ও অধিকারের অবস্থান নির্ণয় সম্পর্কে সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর দ্বিতীয় লিঙ্গ বইতে বলেছেন, “দুটি লিঙ্গের ভূমিকাগত সামর্থ্য নির্ণয়ে মস্তিস্কের ওজন ও বুদ্ধিমত্তার মাত্রার মধ্যে এযাবৎকাল পর্যন্ত কোনো রকম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। মানব প্রজাতির নারী ও পুরুষের মধ্যে শারীরীক বল ও মগজের আয়তনের তুলনা কোনো বিচার্য বিষয় হতে পারে না, বরং এই তুলনা হবে শুধু মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে”।

সিমোন দ্যা বোভোয়ারের এই মতবাদ কেন প্রতিষ্ঠিত সত্য বলে ধরে নেয়া  যেতে পারে এর কিছু সাধারণ ব্যাখ্যা আমরা আমাদের বাস্তব জীবন থেকেই পেতে পারি। বিজ্ঞান বলে যে মানুষের মগজের স্বাভাবিক গঠনের সাথে বুদ্ধিমত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন আয়োডিন ও অন্যান্য খনিজ সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য, সুস্থ পরিবেশ ও সুস্থ মায়ের উপর শিশুর মগজের স্বাভাবিক গঠন নির্ভর করে। তাহলে একজন যত্নশীল সুস্থ স্বাভাবিক মা-পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারী সন্তানই জন্ম দেন। জন্মের পরে শিশুর পরিচর্যা, তার খাদ্য, পরিবেশ এবং শিক্ষা পদ্ধতির উপর শিশুর বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে থাকে।

গবেষণায় দেখা  গেছে যে, উন্নত গঠনশৈলীর মগজের আধিকারী একজন মেধাবী মানুষ সারা জীবনে মগজের সার্বিক বুদ্ধি ক্ষমতার শুধুমাত্র চার শতাংশ ব্যবহার করে। আইনস্টাইন সারাজীবনে ব্যবহার করেছেন তার মগজের মাত্র দশ শতাংশ বুদ্ধি। কাজেই বলা যেতে পারে যে নারী বা পুরুষ যেই হোকনা কেন, মেধাভিত্তিক কাজের জন্য কারোরই বুদ্ধির ঘাটতি হয় না। যেটুকু বুদ্ধিসম্পদ দিয়ে মেধা ভিত্তিক কাজ করা যায় তা নারী পুরুষ উভয়েরই থাকে।

এরপর নারীর তুলনা হয় পুরুষের শারীরিক শক্তির সাথে। শারীরিক শক্তি ব্যাপারটা একটু বেশিই আপেক্ষিক। একজন সবল দেহের মাটিকাটা পুরুষ শ্রমিক প্রচণ্ড পরিশ্রম করে দিনশেষে যা আয় করে একজন ছোটখাট শরীরের পুরুষ বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিভিত্তিক কাজ করে এর থেকে অনেক বেশি আয় করেন, তিনি ক্ষমতাবান ও উন্নত জীবনযাপন করেন। ক্ষমতা নির্ভর করে বুদ্ধি, জ্ঞান, শিক্ষা ও কৌশলের উপর। ফলে নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষের সাথে নারীর শারীরিক শক্তির তুলনা কোনো তুলনাই হতে পারে না।

নারী বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী, আন্তরিক ও ধৈর্যশীল। এইযুগে নারী কর্মক্ষেত্রের বাইরে সন্তান জন্ম দেয়া, প্রতিপালন করা এবং সংসারের নিত্যদিনের দুরূহ কাজকে সহজেই সম্পাদন করে চলেছে।

নারীর এই পরিচয়ের পরেও পৃথিবী জুড়ে নারীর পশ্চাৎপদতার কারণ কি? এর একটা কারণ হলো, দীর্ঘদিনের সামাজিক নিপীড়নে নারী তার সাহস ও বুদ্ধিভিত্তিক কৌশল হারিয়েছে যার অভাবে তারা তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারছে না এবং তাদের যাবতীয় অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। নারী নিজেও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের প্রচারণার ফাঁদে পরে নিজেকে দুর্বলই ভাবে। তাই সে আবেগকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে লালন করে যাচ্ছে যা প্রতিপক্ষের সামনে তাকে আরও দুর্বলই করে তোলে।

চোখের জল বা ক্রোধ বা অভিমান জাতীয় স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণেও নারী দক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে ফলে তার মুষড়ে পরার দুর্বলতা সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। এছাড়া  অভ্যাসবশতঃ নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রচলিত সৌকর্যে গা ভাসিয়ে চলেছে। সে নিজের থেকে অধিক  যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে ভালোবাসে, স্বামীর ক্ষমতায় গর্বিত হতে চায় এবং স্বামীর দেয়া উপহারের প্রলোভনে জড়িয়ে পরে। নিজে স্বামীর কাছে নিরাপত্তা চায় এবং স্বামীর নিরাপত্তা খুঁজে ঈশ্বরের কাছে। নারী নিজের জীবনের ভার স্বামীর উপর চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তারা পরিতৃপ্ত বোধ করলেও নিরন্তর  তার ভিতরে অবক্ষয়ের একটা যুদ্ধ চলতে থাকে। তাই সে নিজের  মূল্য প্রতিষ্ঠিত করতে স্বামীর সাথে নিরন্তর নীরব বা সরব লড়াইয়ে ব্যাপ্ত থাকে এক টুকরো জমি বা একটি বাড়ির মালিকানা ও কিছু অলংকারের জন্য। বিয়ের আসরেও নারী পিতা বা স্বামীর ক্ষমতায় সালংকারা হয়ে গর্ব অনুভব করে।

পুরুষের কাছে নারীর এই আত্মসমর্পনের সুযোগে পুরুষ এক ধরনের অধিকারবোধে  আক্রান্ত হয় এবং আধিপত্য করার একটা অপ্রতিরোধ্য প্রলোভনে মত্ত হয়। বিবাহিত পুরুষ স্ত্রীকে দেখতে শুরু করে ঘটির জল হিশেবে দিনশেষে যার কাছ থেকে নিজের সকল জয় এবং পরাজয়ের প্রতি সমর্থন আদায় করতে পারে এবং নিত্যদিন তার কাছ থেকে সেবা নিয়ে আনন্দিত থাকতে পারে। বাস্তবে মানুষ নিজেকে শ্রদ্ধার আসনে দেখতে ভালোবাসে। তাই বিয়ের প্রথম দিকে নিজ পুরুষটির মর্যাদায় নারীর যে মুগ্ধতা আসে স্বামীর কাছ থেকে নিজে মর্যাদা না পাওয়ায় অচিরেই তাতে ফাটল ধরে। তখন নারী নিজের সামনে প্রিয় পুরুষটিকে দেখে একজন অন্যায়কারী হিশেবে।

সিমোন দ্যা বোভোয়ার বলেন, “নারীর আচরণের বহুদিক আছে, যেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে প্রতিবাদের নানা রূপ হিশেবে। নারী প্রায়ই তার স্বামীর ব্যবহারের প্রতিবাদ করে প্রকাশ্যে অবাধ্যতা দেখিয়ে। কখনো অসাবধান ও অপব্যয়ী হয়ে, কারণ তার স্বামী সুশৃঙ্খল ও মিতব্যায়ী। নারী পুরুষকে ইচ্ছে করে অপেক্ষা করায়, কারণ তার নিজের সমগ্র অস্তিত্বই হচ্ছে প্রতীক্ষার। নিজের কাছে চেক বই রেখেও নিজ ভাতা বা অন্যান্য খরচাদির জন্য তাকে প্রতীক্ষা করতে হয় স্বামীর অনুমোদনের, অপেক্ষা করতে হয় স্বামী বা প্রেমিকের কৃতজ্ঞতার বা প্রশংসার, বিছানায় তাকে প্রতীক্ষা করতে হয় স্বামীর কামনার”।

নারীকে সন্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে নিজের যোগ্যতার উপর আস্থা স্থাপন করতে হবে। বুদ্ধিচর্চা ও বুদ্ধিভিত্তিক কৌশলে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। রূপচর্চা, প্রসাধন, অলংকরণ এবং নিত্য নতুন পোশাকে নিজেকে তুলে ধরার পরিবর্তে নিজেকে অনেক বেশি খুঁজতে হবে রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও  সংস্কৃতিতে। এই খোঁজার মধ্যে নারীর যে অবয়ব তৈরি হবে, তাতে তার প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধা বাড়তে থাকবে। নারীর  অর্থসম্পদের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রূপচর্চা ও পোশাক পরিচ্ছদে। এর একটি অংশ নারী যেন ব্যয় করে নানা প্রশিক্ষণে নিজেকে চৌকশ করে তুলতে। বহু নারী মোবাইলের সাধারণ ব্যবহারের নিয়ম শিখতেও স্বামী বা পুত্র বা অন্য পুরুষের দ্বারস্থ হন, যা তাকে তাদের সামনে দুর্বল নারী হিশেবেই চিহ্নিত করে।

নারী পুরুষের অধিকার সচেতনতা ও আস্থার অভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিয়ে-বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে আশংকাজনক হারে। অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ পর্যন্ত না গড়ালেও বিয়ের কিছুকাল পরেই সেটা হয়ে উঠছে দুঃসহ সহবস্থান। ভালোবাসা তৈরী হয়নি বা ভালোবাসা শেষ বলেই যে ট্র্যাজেডির সূত্রপাত সব ক্ষেত্রেই তা নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ, দায়িত্ববোধ ও প্রাপ্য অধিকারের অভাবে সমস্যা বাড়তে থাকে।   বিয়ে বিচ্ছেদের মূল ঝুঁকিতে পড়ে মেয়েরা। তাদের সমস্ত পরিকল্পনায় যেহেতু স্বামী নির্ভর ছিল, তাই ‘একলা  চলার’ অবস্থাটাকে তারা নিজেরাই অভিশপ্ত মনে করে। এছাড়া যেকোনো অবস্থাতেই তারা সন্তানের দায়িত্ব নিজে নেয়। ফলে সামাজিক, শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক লড়াইটা তাদের জন্য প্রচণ্ড হয়ে উঠে।

বাস্তবে ভারসাম্যপূর্ণ দম্পতি কোনো কল্পনার রাজ্যে বাস করে না। এই সমাজেই তাঁদের বাস যারা একাধারে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু ও স্বামী-স্ত্রী। ছোট্ট ছোট্ট কিছু কৌশল এই বন্ধনকে সমৃদ্ধশালী করে। শর্তহীন ভালোবাসা, কর্মে মননে একজনের প্রতি অন্যজনের আস্থা, বিরূপ মন্তব্য থেকে নিজেকে বিরত রাখা, দেখাশোনা ও বলাকে নব নব রূপে উপস্থাপন করা ও কৌশলে সংঘাত থেকে বেড়িয়ে আসা এবং সর্বোপরি একে অপরকে যোগ্য ভাবার মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়।

জীবন এক মহাসমুদ্র। এখানে টিকে থাকতে হলে সারাক্ষণই সাঁতরাতে হবে। এক নিমেষের জন্য হাল ছেড়ে দিলে ডুবে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। একটাই তো জন্ম। একে আদরে সন্মানে আনন্দে ব্যাপ্ত রাখা যায় একটু উদ্যোগ নিলেই।

রবীন্দ্রনাথ কবেই বলে গেছেন, “এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে। ধুলায় বিছানো শ্যাম অঞ্চলে দাঁড়াও  হে নাথ দাঁড়াও হে”। আমরা সৃষ্টির বিকশিত জীব। ভালোবাসতে জানি, গাইতে জানি, অন্যের জন্য দেশের জন্য প্রাণ উজাড় করে দিতে জানি। ছোট্ট এই জীবনে নারী-পুরুষ মিলে হাতে হাত রেখে ধরণীর মাধুরী বাড়িয়েই যাব আমরা।

শেয়ার করুন: