আতিকা রোমা: খুব ছোটবেলা থেকে আমি বাইসাইকেল চালাতে পারতাম। ঠিক কোন ক্লাস থেকে পারি এখন আর মনে করতে পারছি না। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে উদার এক যৌথ পরিবারে সৌভাগ্যবশত জন্ম নেয়ায় যখন যা করতে চেয়েছি, পেরেছি। সবচেয়ে উৎসাহ ছিল আমার মায়ের। একদম ছোট্টবেলায় মা-ই আমাকে শিখিয়েছে সব করতে।
বাবার বড় ফনিক্স সাইকেল দিয়ে আমার হাতেখড়ি। সাইকেল যখন পূর্ণমাত্রায় শেখা শেষ, তখন মনে হল এবার আমি মোটর সাইকেল চালাতে চাই। ক্লাস ফাইভ থেকেই আমি খুব ভাল ভাবে মোটরসাইকেল চালাতে পারতাম। রংপুর শহরে অনেকেই আমাকে চিনত মোটরসাইকেল চালানোর জন্য। এরপর জীবনের ব্যস্ততায় একটু একটু করে দূরে চলে গেলাম সাইকেল বা মোটোরসাইকেল থেকে। কিন্তু এই স্বাধীনতার ভাল লাগাটুকু সব সময়ই বহন করেছি ভেতরে ভেতরে।
একটা সময় ঢাকায় আসলাম পাকাপাকিভাবে, জীবনের তাগিদে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল আমি কোনভাবেই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতাম না। তাই চাকরী করে যা টাকা আয় করতাম তার প্রায় সবটাই সিএনজি অটোরিক্সার পেছনে চলে যেত। এভাবে চলতে চলতে একবার অনেকটা হুট করেই কিনে ফেললাম ব্যাটারি চালিত বাইক।
২০১২ সালের একদম শুরুর দিকে আমি প্রথম চালাই ব্যাটারি চালিত বাইক। এটা নিয়ে যখন ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হলাম, লোকজনের বিস্ময় আর চলতি পথে নানা প্রশ্ন দিয়ে শুরু হল যাত্রা। ব্যাটারির বাইক কেনার ব্যপারে আগ্রহটা ছিল এই কারণে যে এতে ড্রাইভিং লাইসেন্স বা বাইকের রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ব্যাটারির বাইক নিয়ে অচিরেই সমস্যায় পরলাম। ২৫-৩০ কিলোমিটার যাবার পর চার্জ ফুরিয়ে যায়। তখন লোকজনের কাছে অনুরোধ করে আবার ১-২ ঘন্টার জন্য চার্জ দিতে হত। চার্জে খুব বেশী ইলেক্ট্রিসিটির প্রয়োজন হত না, কিন্তু সেটা বোঝানোই খুব ঝামেলার হয়ে যেত।
এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়েই ২০১৩ সালে স্কুটি কিনলাম বিক্রয় ডটকমের বিজ্ঞাপন থেকে। সেকেন্ডহ্যান্ড, যেটা রেজিস্ট্রেশন করাই ছিল। কাজেই কেনা মাত্রই শুরু হল ঘোরাঘুরি আর ছোটাছুটি। আমার বাড়ি এবং অফিসের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিঃমিঃ। বাড়ি থেকে কেউ কখনও বাধা দেয়নি, তাই চালানোটা খুব সমস্যার হল না।
স্বাধীনতা বেড়ে গেল, মুক্ত হয়ে চলাফেরার আনন্দটাও ঘুরেফিরে বুঝতে পারলাম। মাস শেষে অফিস যাতায়াতের খরচটাও ভীষণ ভাবে কমে গেল। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে আমি কোনদিনই চলাচল করিনি। তাই বেতনের অনেক বড় একটি অংশ চলে যেত সিএনজিওয়ালার পকেটে। আগে যেখানে মাসে খরচ হত ১২০০০ টাকার মত, স্কুটিতে এসে সেটা ঠেকল মাত্র ২৫০০ টাকা তেল, মবিল, সার্ভিসিং সব মিলিয়ে। আর যখন যেখানে যাবার ও একটু রাত করে ফেরারও কোন সমস্যা থাকল না।
তবে ২০১৩’র দিকে সেই অর্থে খুব বেশী মেয়ে স্কুটি চালাত না। যারা চালাত তাদের সংখ্যাটা বেশ চোখে পড়তো। প্রথম প্রথম ফাঁকা রাস্তা পেলেই বাসওয়ালা, পিকআপ ওয়ালা, মালিক বিহীন প্রাইভেট কারওয়ালারা খুব বিরক্ত করত। ফেলে দেবে বা একবার সামনে একবার পেছনে গিয়ে বাধার সৃষ্টি করত। ২০১৩র এক হরতাল সকালে এমনই একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল যে একদম ফাঁকা রাস্তায় নেহায়তই দুষ্টামির ছলে একটি চলন্ত পিকআপ চলন্ত অবস্থায় সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আমাকে। এতে করে আমার ডান হাত তিন টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়। তারপর চিকিৎসা করে হাতটি ভাল হয়। এরকম ছোটবড় বেশ কটি দুর্ঘটনার পরও স্কুটিই আমার সঙ্গী।
ভাল অভিজ্ঞতাও রয়েছে অনেক। খুব ভিড়ের মধ্যে অনেক সময় ঢুকতে কষ্ট হয়। তখন আসেপাসে যেসব ছেলে বাইকার থাকেন তারা যায়গা করে দিয়ে বলেন, আপু চলে আসেন এখানে কোন সমস্যা নেই। একবার বাসায় ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্যান্টনম্যান্টের জাহাঙ্গির গেটের আগেই পরলাম অনেক ঝড়ের মধ্যে। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। একটি বাইক এসে পাশে থামল, বলল, এই ঝড়ের মধ্যে চালানোর চেষ্টা করেন না আপু। আসেন ঐ গাছটার নীচে দাঁড়াই। গাছের নীচে গিয়ে দেখলাম আরও ১০/১৫টি বাইক। সবাই ভিজছে। প্রতিটা ছেলেই খুব সম্মান দেখাল। ঝড় থামলে জানতে চাইল আমি কোনদিকে যাব। জানালাম, উত্তরায় যাব। সাথে সাথে ৪-৫জন জানালো, তারাও উত্তরায় যাবে। আমরা সবাই একসাথেই ধীরে ধীরে উত্তরার পথে চললাম। সেদিন এতো নিরাপদ লেগেছিল, এতো ভাল লাগা যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
এরকম হাজারও ভাল লাগা মন্দ লাগা নিয়ে স্কুটিসহ পথচলার ২ বছর পার করে ফেললাম। এখন মনে হয় এই স্বাধীনতার প্রেমে পরে গেছি। স্কুটি চড়লেই নিজেকে পাখি মনে হয়। মনে হয় এবার ডানাগুলো মেলে দিয়ে পাখির মত উড়ে চলার পালা।
যারা চালাবেন বলে ভাবছেন, ভাবনা বাদ দিয়ে শুরু করুন। কোন ভয় নেই। স্কুটির যে স্বাধীনতা এবং যাতায়াতের যে সুবিধা তা একবার চালালেই বুঝতে পারবেন। স্কুটি চালানোর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাহস, পরিবারের সমর্থন এবং যেকোন ধরণের এক্সিডেন্টে ভয় না পেয়ে সুস্থ্য হয়ে আবার চালান শুরু করা। মনে রাখবেন না চালালে এক্সিডেন্ট হবে না। আর এক্সিডেন্ট হলে চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া যায়।
আতিকা রোমা
এডভোকেসি অফিসার (জাপান ভিত্তিক দাতা সংস্থা শাপলা নীড়ে কর্মরত)