অদিতি ফাল্গুনী: রাজশাহী থেকে এক বন্ধু ফোন করলেন। হতভম্ব, বিমূঢ় অবস্থা। বললেন, ‘অদিতি, সিলেট আর খুলনায় আওয়ামি লীগের মেয়ররা দুর্নীতি করলেও রাজশাহীর মেয়র তো শহরের জন্য প্রচুর কাজ করেছিলেন। এত কাজ কেউ করে না কখনো। বরিশালের মেয়রও তো করেছেন। তবু হারল কেন?’ একটু থেমে নিজেই উত্তর দিতে লাগলেন, ‘তৃণমূলে বিএনপি-জামাত-হেফাজত অবশ্য এখানে একটাই প্রচার চালিয়ে গেছে যে আওয়ামী লীগ এলে মসজিদ সব ভেঙ্গে ফেলবে। মুসলমানদের মেরে ফেলবে। সেটাই সবাই শুনেছে।’
সম্ভবত: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি-জামাত-হেফাজত জয়ী হতে চলেছে। বাংলাদেশের যে যুদ্ধ ১৯৭১-এই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল তা’ হয় নি। শাহবাগ সেই অসমাপ্ত যুদ্ধের শেষ লড়াই ঘোষণা করেছিল। হেরে কি যাচ্ছে মুক্তবুদ্ধি ও আলোকিত পক্ষই? একাত্তর নিয়ে আমাদের কি খুব তেতো কিছু পুনর্মূল্যায়ণ দরকার? ’৭১-এর সেই পূর্ব পাকিস্তানের অন্তত: ৫০ ভাগ মানুষ কি নীরবে পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন? নাহলে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি কেন এত হারবে? বারবার? আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করে? তারেক-কোকো-ইস্কান্দার-বাবরদের লুণ্ঠন ও সন্ত্রাসের কাছে কি? কতটুকু? বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ? একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মত ন্যাক্কারজনক অপকর্ম কোনদিনই কি করেছে আওয়ামী লীগ? গতকালও একটি মন্দির ভাঙ্গা গেছে। আজ জয়ের উল্লাসে আরো কিছু হিন্দু মন্দির ভাঙ্গা পড়বে নিশ্চিত। রোজ একটি করে হিন্দু মন্দির ভাঙ্গবে আর ইসলাম তত বিপন্ন হবে নব্বই ভাগ মুসলিমের এই দেশে। একজন যুদ্ধাপরাধীরও শেষমেশ ফাঁসি হবে না এই দেশে। ধর্মকে যতরকম কদর্যভাবে ব্যবহার করা যায় করা হবে। সেটা নিয়ে এক শ্রেণীর বামপন্থীরা কিন্তু নোট লিখবে না। তারা কথায় কথায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ী’দের আক্রমণ করলেও ‘ইসলাম ব্যবসায়ী’দের বিরুদ্ধে কিছু লিখবে না। বরং সুকৌশলে সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষ, বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও মু্ক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ ছড়াবে। আছে নিরপেক্ষতা বটিকা বিক্রিকারীরাও! ক্ষমা কি করতে পারি নিজেকেই? ‘বিপ্লবের বড়ি’ খেয়ে, ‘নিরপেক্ষতার সালসা’ পান করে এমন সব কথা কখনো কখনো লিখেছি, যা কুড়াল মারলে সবার আগে আমার পায়ে আর আমার অস্তিত্বেই কুড়াল মারে।
বিএনপি-জামাত-হেফাজতের উপর রাগ করি না। ওরা ধর্ম ব্যবসায়ী। ধর্ম খাটিয়ে তাদের খেতে হয়। আওয়ামী লীগ তৃতীয় বিশ্বের এই বাস্তবতায় আকাশ থেকে আসা কোন দল নয়। টুকটাক কিছু অন্যায় তার কোন কোন নেতা-কর্মী করলেও মোটা দাগে এই দলের কোন বিকল্প আজো কি হয়েছে এই দেশে? আজ ধিক্কার দিই, ঘৃণা ও অভিসম্পাত দেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে আফগান বিপ্লবের ফেরিঅলাদের…ধিক্কার, ঘৃণা ও অভিশাপ দিচ্ছি আমি আমাকে ও আমার মত আরো অনেক ‘দুধভাত’ কে…রুশ-চীন আর ইরান-আফগান বিপ্লবের পার্থক্য বুঝেও না বোঝার মত আচরণ যারা করেছি বারবার। একটি প্রজন্ম আমরা শুধুই বিভ্রান্ত আর সংশয়ী হয়ে আত্মহত্যা করে গেছি ক্রমাগত। নিরপেক্ষতার বাঁশি বাজিয়ে গেছেন আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান সম্পাদক। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত মোহন, রূপোলী তার বাদনে মুগ্ধ একটি প্রজন্ম ছুটে গেছে সেই অন্ধকারে যেখানে রূপকথার বাঁশিওয়ালা নিয়ে গেছিল জার্মানীর একটি শহরের সব শিশুকে! আমরা না হয় দিকভ্রান্ত হয়েছি। কিন্তু যারা জেনে-শুনে, যে জ্ঞান-পাপীরা রুশ-চীন আর ইরান-আফগান বিপ্লবের পার্থক্য বুঝেও বারবার গুলিয়ে দিয়েছে সব…সেই জ্ঞান পাপীরা হেফাজত-জামাতের কাঁধে সওয়ার আসন্ন বিএনপি শাসনে তাদের ওয়াইন-গাঁজা-গার্লফ্রেন্ড সহ ‘উত্তরাধুনিক, ইসলামী মার্ক্সবাদে’র অনুশীলন কিভাবে অব্যাহত রাখে তা’ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক পরিচিতি: অদিতি ফাল্গুনী, লেখিকা।