রান্না করতে গায়ের জোরের দরকার নেই

Women Riseউম্মে ফারহানা: শুধু ভার্জিনিয়া উলফ পড়বার সময়, আর এড্রিয়েন রিচ পড়াবার জন্য যতটুকু ফেমিনিজমের পাঠ দরকার, নারীবাদী তত্ত্ব ঠিক ততটুকুই জানা আমার। স্বীকার করে নিচ্ছি তা যে কোন নারী ইস্যুতে লেখালেখি করবার জন্য যথেষ্ট নয় মোটেও। তবে প্রিয় লেখক নবনীতা দেবসেনের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে পড়লাম তিনি মনে করেন নারীবাদ যে যার মত করে ধারন করে, যেহেতু নারীবাদ অনেক রকম আছে, সবাইকে একইভাবে এটি চর্চা করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সেই সাহসেই কিছু বিষয় নিয়ে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করছি।

একজন কর্মজীবি নারী হিসেবে অবশ্যই আমি বা আমার মতন অনেক নারীকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। আমার মনে হয় ইদানীং এই চ্যালেঞ্জটির আকার আকৃতি ও ব্যপ্তি অনেক বেড়েছে। যে সুপার ওম্যান মিথ সমাজ তৈরী করেছে, মিডিয়া যাকে পেলেপুষে বড় করেছে সেই মিথ অনুযায়ী সুপার ওম্যান হতে পারা আমাদের আজকের দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পুরুষকে সুপার ম্যান হতে হয় না। এই মিথের ধারক বাহক পুরুষরা বদলাচ্ছে না। আমার মতে, সবচেয়ে হুমকির বিষয় এটাই।

আমাদের এক সহকর্মী, জুনিয়র ও ব্যাচেলর। প্রায়ই দাওয়াত করে খাওয়ান আমাদের। একদিন রান্না প্রসঙ্গে কথা উঠতেই আরেক পুরুষ সহকর্মী তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। আমি বললাম যে সে খাসীর মাংসে ধনিয়া দেয়না, যেটি, আমার মতে, গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আমার সহকর্মী ধনিয়া ছাড়াও রেডমিট রাঁধা যায় – এই মর্মে তর্ক করলে খুশি হতাম,কিন্তু তিনি তা না করে বললেন, “আরে বেটামানুষ রানতে পারে এই বলে বেশি”। আমি কথা বাড়ালাম না। কারণ এই ব্যক্তির স্ত্রী একজন গৃহিণী।  তাঁর সংসারে স্পষ্ট শ্রমবিভাজন রয়েছে। তাঁকে যদি বলতাম যে রান্না করতে পারাটা একটি চর্চাগত বিষয়, মাসিক ঋতুর মতন বা গর্ভধারণের মতন কোন জৈবিক বৈশিষ্ট নয় যে মেয়ে মাত্রই পারবে আর পুরুষ মাত্রই পারবেনা, উনি মেনে নিতেন না।আমার বলতে ইচ্ছা করেছিল, “ভাইয়া, আমি যদি ক্লাস নিতে  গিয়ে ভুল করে গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য না বলি কিংবা ফলাফল দিতে গিয়ে প্রথম হওয়া ছাত্রকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বানিয়ে দিই, আপনি কি বলবেন মেয়েমানুষ হয়ে মাস্টারি করছে এই না বলে বেশি?” বলিনি কারণ সেটা অরণ্যে রোদন হত।

কিন্তু আরেকদিন এক ডাক্তার বান্ধবীর  স্বামী, যিনি নিজেও ডাক্তার এবং বান্ধবীর কাছে শুনেছি, রাঁধতেও পারেন, একইভাবে ভাবেন তা জানালেন। আমি অবাক হলাম কারণ এঁর স্ত্রী গৃহিণী নন, সমান যোগ্যতা নিয়ে লেখাপড়া করেছেন একই প্রতিষ্ঠানে, কাজ করছেন একইরকম ব্যস্ততায়, একইরকম মর্যাদায়, এঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটু উদার হবে ভেবেছিলাম। আমি যখন আমার সহকর্মীকে না করা প্রশ্নটি এঁকে করলাম ইনি বললেন, “আমি যে ওজন ওঠাতে পারি একটা মেয়ে যদি তা না পারে আমি কি হাসব তাঁকে নিয়ে? মেয়েদেরকে ওই সামর্থ দেওয়া হয়নি”।

একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফিজিওলজি এনাটমি নিয়ে তর্কে যাওয়া যায় না, ক্ষান্ত দিলাম। কিন্তু মানতে পারলাম না যে পুরুষকে রন্ধনপ্রতিভা ‘দেওয়া হয়নি’। রান্না করার জন্য শারীরিক শক্তির প্রয়োজন নেই এটা উনিও জানেন। তবু এটিকে তুলনা করলেন নারীর শারীরিক শক্তি কমের সঙ্গে। কথা বাড়ালে হয়ত পুরাতন পদ্ধতিতে নারীর মগজের ওজন নিয়ে কথা তুলতেন।

আমার বান্ধবীর স্বামী নিজেও রান্না করেন, স্বীকার করলেন, স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার বশে উনি ক্লান্ত অফিস ফেরত স্ত্রীকে রেঁধে খাওয়ান প্রায়ই। কিন্তু মনে করেন রান্নাটা মেয়েদের একচেটিয়া ব্যাপার। পুরুষরা সেটি করতে পারলে সেটা বাড়তি একটি গুণ। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি গুণ নয়, এটি তাঁর জন্য অবশ্য করণীয়। এই জায়গাতেই আমার মনে হয়, ভয় পাবার মতন ব্যাপার আছে।

যারা গৃহকর্মীর বিকল্প হিসেবে জীবনসঙ্গিনীকে বিবেচনা করেন তাঁরা যতটা ক্ষতিকর, এই রান্না করে স্ত্রীকে খাওয়ানোর জন্য কৃতিত্ব দাবী করা এবং নারীকে তাঁর প্রাপ্য কৃতিত্বটুকু দিতে না চাওয়া পুরুষরা আরও বেশি ক্ষতিকর, নারীবাদী ইস্যুতে। এই ধরণের মানসিকতা না পাল্টালে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। সে স্ত্রীরা যতই অবরোধ ভেঙ্গে বিপ্লব করুক, স্বামীর সমান মর্যাদা ও সমান বেতনের চাকরি করুক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করুক।

আমি নিজে স্বামীকে রান্নাঘরে  পাঠিয়ে কোনরকম অপরাধবোধে ভুগিনা, স্পষ্ট শ্রমবিভাজন আমার পরিবারে নেই। নারীও রোজগার করে,বাইরের কাজ করে, পুরুষও কাপড় ধোয়, বাসন মাজে। কিন্তু আমাদের বাসায় আসা কাজের বুয়া থেকে শুরু করে মাতৃস্থানীয় আত্মীয়ারা সকলেই দেখলাম আমার স্বামীর এই কাজ ভাগ করে নেওয়ার গুণে মুগ্ধ। পুরুষরা ততটা মুগ্ধ নয়, অনেকে বরং আমার স্বামীর উপর বিরক্ত, ব্যঙ্গ করে বা তুচ্ছ করে কথা বলতেও শুনেছি অনেককে, বিশেষত যাঁদের স্ত্রীরা গৃহিণী, তাঁরা যেন আমার স্বামীকে একজন স্ত্রৈণ বলেই ধরে নিয়েছেন। অথচ সত্যিকারে বিষয়টি তেমন নয়। আমার স্বামী নারীবাদীও নন, তিনি একজন স্বঘোষিত পুরুষতান্ত্রিক।

লেখার শুরুতেই বলছিলাম, নারীবাদ বিভিন্ন রকম হয় বলে সম্যক জ্ঞান না থাকার পরও লিখছি। এদেশে নারীবাদ নিয়ে বিভিন্ন রকম আজব ধারণা আছে, মেয়েরাও স্পষ্ট বলতে পারে না সে ফেমিনিস্ট কিনা, পুরুষরা ফেমিনিস্ট হলে অন্য পুরুষরা তাঁকে প্রায় নপুংসক বলে ধরে নেয়। কিছু পুরুষ প্রগতিশীল হবার জন্য নারীবাদী ভাব ধরেন, আর ভেতরে ভেতরে থাকেন অত্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক। যেভাবে রান্না করতে  জৈবিকভাবে নারী হবার দরকার নেই, ঠিক তেমনিভাবে তত্ত্ব মেনে নারীবাদী হওয়াটাও মনে হয় খুব জরুরী নয়। নারী রান্না না করে চাকরি করলেই যেমন ‘লিবারেটেড’ হয়ে যায় না, পুরুষ ঘরের কাজে সাহায্য করলেই নারীবাদীও হয়না বা নপুংসক হয়েও যায় না।

মাকে, স্ত্রীকে, বোনকে বা কন্যাকে মানুষ হিসেবে ভেবে তাঁর কষ্ট লাঘবের জন্য ঘরের কাজে সাহায্য করাটাও এক অর্থে নারীবাদী আচরণ যা করেও আমার স্বামী নারীবাদী নন, শুধুমাত্র তত্ত্বগত স্পষ্টতার অভাবে। কিংবা হয়ত নিজের পুরুষসত্ত্বার প্রতি পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মুগ্ধতার বশে।

তাই পুরুষদের বলছি, রান্না করতে শারীরিক জোর লাগেনা, ‘অবলা’ নারীই পারে, আপনি শক্তিমান, আপনিতো পারবেনই। নারীকে সুপার ওম্যান হতে বাধ্য করা বা বাধ্য করতে চাওয়া পুরুষরা, তত্ত্বগতভাবে নারীবাদী না হয়েও নিশ্চিন্তে স্ত্রীকে সাহায্য করুন, রান্না করুন, বাসন মাজুন, কাপড় কাচুন। আপনার পৌরুষ বা পুরুষতান্ত্রিকতা কোনটিরই ক্ষতি হবেনা। কট্টর মেল শভিনিস্ট হয়েও আপনি তা করতে পারেন, রান্না করবার জন্য নারীবাদী হওয়া লাগে না।

 

সহকারী অধ্যাপক

ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.