মমতাদিকে খোলা চিঠি

Mamata-Hasinaসুমন্দভাষিণী: প্রিয় মমতাদি, আপনি আমার নমস্কার জানবেন। সালামও জানতে পারেন। জেনেছি আপনি নাকি গতবার রোজার সময় আপনার অঞ্চলের মুসলিম ভাইবোনদের সাথে বসে মাথায় কাপড় দিয়ে, রীতিমতোন হাত তুলে দোয়া-দরুদ পড়ে ইফতার খেয়েছেন। অনেকে তো আবার বাড়িয়ে বলে যে, আপনি নাকি নামাজও পড়েছিলেন। জানি না, সত্যি কি মিথ্যা। তবে রাজনীতি যে কঠিন একটা বিষয়, সেখানে টিকে থাকতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অনেক সমালোচনার শিকার হতে হয়, অনেক অভিনয়ও জানতে হয়, সে আমরা জানি। এ নতুন কিছু না, তাই কিছু মনে করিনি।

কিন্তু, এখানে একটা কিন্তু আছে দিদি। রাজনীতি করলেই তো মানুষকে ‘দুষ্ট’ হতে হবে, এমন দিব্যি কি কেউ দিয়েছে? আপনার নিজের দেশেও উগ্রপন্থীদের কারণে আপনারা নাকানি-চুবানিতে আছেন, তেমনি আমরাও আছি। এখন ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে, কেবলমাত্র টিকে থাকার জন্য আপনি সেই উগ্রপন্থীদের সাথে তাল দেবেন, তাতো হয় না দিদি! আর যারা আপনার প্রতিবেশি একটা দেশ, যারা কিনা আপনার মতোনই বাংলায় কথা বলে, সেই দেশের চরম শত্রু জামায়াতে ইসলামিকে যদি আপনি প্রশ্রয় দেন, তাহলে বিষয়টা কেমন গোলমেলে হয় যায় নাকি? তার মানে তো আপনি আমাদের অস্তিত্ব, সংস্কৃতিকে যারা পাল্টে দিতে চায়, তাদের সমান হয়ে গেলেন। আপনিও কি চান আমরা বাঙালী জাতি হিসেবে বিলুপ্ত হই?

এই যে আপনি আজ আমাদের দেশে এসেছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে, একুশে পালন করতে। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো দিদি, আপনার বুক ভরে যাচ্ছে না এই বাংলায় শ্বাস নিতে গিয়ে? কেমন দেখলেন আমাদের শহীদ মিনার? দেখেছেন রাত-বিরেতে কত মানুষের ঢল শহীদ মিনারে? এরা সবাই দেশকে ভালবাসে, বাংলাকে ভালবাসে। আপনিও আমাদের ভালবেসে দেখুন, লোকসান হবে না এতে।

এই যে আপনি কাল সোনারগাঁও হোটেলে বক্তৃতা করলেন, কবিতা পড়লেন, প্রতিটি মানুষ আপনাকে শুনলো, বুঝলো, এই যে এক ভাষার কারসাজি, এ আপনি কোথায় পাবেন দিদি? একজন মানুষকে ছুতেঁ পারার অন্যতম মাধ্যম এই ভাষা। মায়ের পেট থেকে পড়েই আমরা এই ভাষায় কথা বলি, স্বপ্ন দেখি, গান গাই, ভালবাসি। মরেও যাই এই ভাষাতেই। সেখানেই আজ যারা মরণ কামড় বসাতে চাইছে, আপনি তো তাদেরকে লালন-পালন করতে পারেন না দিদি। ওদের সাথে গাঁটছড়া ভাঙুন।

আর গত দুদিন ধরে আমাদের যে ‘আদিখেলাপনা’ আপনি এবং আপনারা দেখছেন, তাকে মোটেও দুর্বলতা ভাববেন না। আমরা এরকমই। আমরা আপনাদের সম্পর্কে অজ্ঞান, আর আপনারা ততটাই ম্রিয়মান। বন্ধুত্ব তো কেবল মুখের কথায় হয় না গো দিদিসোনা, কাজে হয়। আমাদের তিস্তা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, সেখানে তখন কৃষকরা  উপোস করেন দিনের পর দিন। ওই কৃষকরা কিন্তু সরকার না, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। তারাও বাংলায় কথা বলেন। একুশে বোঝার আগেই তাদের পেটে খিদে ভর করে। আর ওই যে ছিটমহলগুলো আছে না, সেইসবখানে আপনি যান, দেখে আসুন দেশহীন হওয়া কতো কঠিন!

আপনি কাল বলেছেন, ‘আমাদের সমস্যা আছে, আপনাদের সমস্যা আছে, আপনার ওপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন, আপনি সব ঠিক করে দেবেন’। আস্থা রাখা ছাড়া আমাদের আর কীইবা করার আছে দিদি। ওই আস্থাটুকুই আমাদের সম্বল, শেষ আশ্রয়।

আমাদের অনেক সমস্যা আমরা জানি, তাই বলে একেবারে ভুলোমন আমাদের নয়। অতিথিকে আপ্যায়ন করা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। বিশেষ করে একটা জাতীয় দিবসে বিদেশি, বিশেষত কোনো বাংলাভাষীকে পাশে পেয়ে আমরা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। কিন্তু দাবি আমাদের শতভাগ, এতোটুকু ছাড় দিতে রাজী নই। আপনার গলায় ঝাঁঝ আছে, সে আমরা ভালই জানি। গতবার মনমোহন সিংয়ের সাথে আপনার আসার কথা ছিল, আপনি বলেছেন, শেষমূহূর্তে কারা নাকি কি প্লে করেছে, তাই হয়নি, কিন্তু সেবার আপনার কঠোর মনোভাব আমাদেরকে আশাহত করেছিল। বেচারা মনমোহন সিং সেবার কী অস্বস্তি নিয়েই না ফেরত গিয়েছিলেন।

এবার এসেই যেহেতু পড়েছেন, স্যুটকেস গোছানোর সময় যেহেতু কেউ কিছু প্লে করেনি, তাই শুধুই ‘আশার বাণী’ নয়, কাজে প্রমাণ দিয়ে যাবেন যে, আপনি আমাদেরই ভাষাভাষি লোক……। আর ‘হাশিনাজি’র সাথে আপনার যেকথাই হোক না কেন, শুধু হেসে হেসে কথা বললেই হবে না। জামদানি শাড়ি আর ইলিশ মাছ কয়টা বিক্রি হচ্ছে, সেই খবরও আমরা রাখবো আশা করি।

আর ‘শিনেমা’র কথাও বলেছেন আপনি। আপনাদের ‘শিনেমা’ আমরা দেখি, নাটক দেখি, ‘শিরিয়াল’ দেখি। আমরা এবার চাই, আপনারও দেখুন আমাদেরগুলো। তাহলে আপনাদের কী লাভ হবে জানি না, আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব আসবে। বাংলা ভাষায় ভাল কিছু তৈরি হতেও পারে তখন।

তাই বলছিলাম কি দিদি, শুধু কথা দিয়ে খৈ ভিজিয়ে চলে যাবেন না। কাজ দিয়ে প্রমাণ করে দিন আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা কতটুকু! পাশাপাশি দেশ, অভিন্ন সীমান্ত, অভিন্ন ইতিহাস, প্রায় অভিন্ন সংস্কৃতি আমাদের। চলুন, একে আমরা আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরি বিশ্বে। জয় আমাদের হবেই তখন। ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’. আমরা এটা বিশ্বাস করি ইতিহাস থেকেই। আমরা চাই আপনিও করবেন, আজ না হয় কাল।  আবারও নমস্কার দিদি।

 

শেয়ার করুন: