উইমেন চ্যাপ্টার: পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাপড়ে ঢাকা নারীই এখন আফগানিস্তানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালেবান শাসন থেকে শুরু হয়েছে নারীর এই পশ্চাদপদযাত্রা। শুধু পোশাকেই নয়, নারীকে অবদমনের সব কায়দা-কানুনই বহাল আছে দেশটিতে। তাদের পড়ালেখা বন্ধ, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা তো ভাবাই যায় না। তাছাড়া পুরো দেশটাই যখন তালেবান জঙ্গিদের শিকার, তখন আলাদা করে আফগান নারীকে ভাবাও যায় না। প্রতিদিন বোমা হামলা, আত্মঘাতী হামলায় জর্জরিত দেশটিতে এরপরও মানুষ চলছে। কিছু নারী এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন পরিমণ্ডলে, যেমন রাজনীতিতে, তেমনি শিক্ষায়-সংস্কৃতিতেও। খেলাধূলাতেও তারা পিছিয়ে থাকছেন না।
অথচ ‘সোভিয়েত আগ্রাসনের’ সময়ও কিন্তু আফগান নারীদের জীবন ছিল অন্যরকম। তারা তখন ছোট পোশাক পরতেন, নাইট ক্লাবে যেতেন, কোথাও কোন বাধা তাদের ছিল না। ইসলামের নামে যখনই যে ক্ষমতায় এসেছে, প্রথম খড়্গটা পড়েছে নারীর বিকাশের উপরই। তাকে আটকানো হয়েছে চার দেয়ালের মাঝে, তাকে বেচাকেনার যোগ্য করা হয়েছে, তাকে কেবলই সন্তান জন্মের আধার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে গত কয়েক বছরে। সেই আফগানিস্তানে আবারও নারীরা ফিরতে শুরু করেছেন, এটাই আশার কথা।
আফগান নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে সাইকেল দাবড়ে বেড়ানোর কথা কিছুদিন আগেও কেউ ভাবতে পারেননি। কিন্তু ভেবেছিলেন পেশাদার আফগান সাইক্লিস্ট আবদুল সাদিক। সাদিকের উৎসাহ আর চেষ্টায় কিছু আফগান নারী এখন সাইকেল চালনা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সাইকেল চালিয়ে ভবিষ্যতে ‘হিরো’ হতে চান তাঁরা।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাইকেলের ডানায় করে আফগান নারীর এই স্বপ্নযাত্রার কথা।
রাজধানী কাবুলে কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে সাদিক গড়ে তুলেছেন একটি সাইক্লিস্ট দল। উত্তরাঞ্চলের অব্যবহৃত একটি সড়কে সপ্তাহে তিন দিন করে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। প্রথমে নিজের মেয়েকে শিখিয়েছেন। সেই মেয়ে দেশের বাইরে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী সাদিক আরও কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সাইক্লিস্ট দল।
আবদুল সাদিকের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন মরিয়ম মারজান। তিনি আশপাশের স্কুলগুলোতে গিয়ে সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগ্রহী মেয়েদের খুঁজে বের করেন। তবে এই কাজটা অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই তাকে করতে হচ্ছে। মারজান বলেন, ‘বাবা যদি মেয়েকে বাধা নাও দেন, ভাই বা চাচা-মামারা তাকে বাধা দেবেন। কাউকে না কাউকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে মেয়েকে চলতে হয়।’
এই সাইক্লিং দলে আছেন মাসুমা (১৮) ও জারাব (১৭) নামের দুই বোন। তাঁরা জানালেন, তাঁদের সাইকেল চালানো শেখা নিয়ে বাবা ও ভাইদের আপত্তি নেই, তবে চাচারা নানান কথা শোনান বাবাকে। বাবাকে পেলেই আজেবাজে কথা শুনিয়ে দেন তারা।
মেয়েদের সাইকেল চালানো শেখাতে গিয়ে নিজেও স্বস্তিতে নেই প্রশিক্ষক আবদুল সাদিক। সম্প্রতি তাঁকে বেদম মারধর করা হয়েছে। আর হত্যার হুমকি তো আছেই। তাই বলে দমে যাওয়ার পাত্র নন সাদিক। তিনি ভালো করেই জানেন, প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থানে পৌঁছাতে হলে তাঁকে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে এর মধ্যেই আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মেয়েদের হারিয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থীরা।
প্রশিক্ষক সাদিকের মতো স্বপ্ন দেখেন প্রশিক্ষণার্থীরাও। ১৬ বছর বয়সী জেলা যেমনটা বলছিল, ‘আমরা সাইক্লিং চালিয়ে যেতে চাই, কারণ একদিন আমরা ‘হিরো’ হতে চাই।’ আর ১৮ বছর বয়সী জয়নবের স্বপ্ন, একদিন তিনি মনের সুখে একা একা সাইকেল চালাতে বের হতে পারবেন। কেউ তাঁকে হেনস্তা করবে না।
১৬ বছর বয়সী জাহরা আলীজাদা দলের অন্যতম উঠতি তারকা। সে বলছিল, একজন মেয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, লোকজন তাকে হয়রানি করে। কিন্তু তুমি যদি বাইকে চড়ে বের হও, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই তোমাকে কাউন্ট করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান মাউন্টেইন টু মাউন্টেইন এর প্রতিষ্ঠাতা শ্যানন গালপিন বেশ কয়েক বছর আফগানিস্তানে থেকে ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছেন, এবং দেশজুড়ে সাইক্লিং করেছেন। তিনি আফগান এই সাইক্লিং গ্রুপটার প্রশিক্ষণের সাথেও জড়িত। তিনি বলছিলেন, আফগান মেয়েরা যদি এই ঝুঁকিটা নিতে রাজী থাকে তবে আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা করতে পারি। তার সংগঠনটি এই মেয়েদের বাইক দিয়ে, উপকরণ দিয়ে এবং এমনকি স্পনসরশিপ জোগাড় করে সহায়তাও করছে।
গালপিনের মতে, সাইক্লিং হচ্ছে নারী অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এটা অংশ। বাইক হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের এবং স্বাধীনভাবে ভ্রমণের অন্যতম প্রতীক। তিনি বলেন, সাইকেল দামেও সস্তা এবং মেয়েদের স্কুল-হাসপাতালে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়ও। হামলাকারীদের জন্যও তখন কঠিন হয় এসব নারীর ওপর হামলা চালানো।
তবে গালপিন এটাও বলেন যে, আফগান সাইক্লিং টিমকে আরও অনেকটা পথ পেরুতে হবে। এই মেয়েরা এখনও তেমন প্রতিযোগিতামুখী হয়ে উঠতে পারেনি। গত কয়েক বছরে তারা কেবল সাইকেল চালানো শুরু করেছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই মেয়েরা দেশি-বিদেশি প্রতিযোগিতায় জয়ী হচ্ছে, স্পোর্টসের বিভিন্ন দিকে তারা দৃঢ়তা এবং সাহসের পরিচয় দিচ্ছে।
# উইমেন চ্যাপ্টার এর পক্ষ থেকে আফগান নারীদের এই স্বপ্নযাত্রার সাফল্য কামনা করছি।