সমাজতন্ত্রী পুরুষের নারীভাবনা

Feminism 2তামান্না কদর: নারীবাদের প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়ার ১৯৪৯ সালে যখন রচনা করেন ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ তখনো তিনি নিজেকে নারীবাদীর বদলে সমাজতন্ত্রীই বলতেন। কিন্তু জীবনের শেষ বেলাটিতে তিনি উপলব্ধি করেন; না, সমাজতন্ত্রও নারীকে মুক্তি দিতে অক্ষম। এটাও আরেক ধরনের পুরুষতন্ত্রই বলা চলে।

১৪ ই জুন ১৯২৮ সালে জন্ম নেন চে গুয়েভারা। মৃত্যু বরণ করেন ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। বিপ্লবের প্রতীক, সাম্রাজ্যবাদ ও শোষক শ্রেণীর প্রতি কঠোর এ সমাজতন্ত্রী ব্যক্তিজীবনে নারী-পুরুষের প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করতেন!

যা পাই তাতে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতে পারি না। চে বলিভিয়ার গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেবার সময় শিশুকন্যা অ্যালেইদাকে চিঠি লিখেন- ‘ আমার ছোট্ট অ্যালেইদা। তুমি অবশ্যই বড় হয়ে উঠবে এবং মাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করবে। দাদিকেও বাড়ির কাজে সহায়তা করবে। স্কুলে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না্’ এমনটি। পুত্র এরনেস্তো গুয়েভারাকে লিখেন, ‘তুমি বেড়ে ওঠ। বেড়ে ওঠার পরও যদি যুদ্ধ চলতে থাকে তবে আমি আর তুমি একসঙ্গে যুদ্ধ করবো। কিন্তু যদি যুদ্ধ থেমে যায় তবে আমি তোমাকে নিয়ে চাঁদে ছুটি কাটাতে যাবো।’

আর নয়টা-দশটা সাধারণ পুরুষতান্ত্রিক বাবার চিঠি লিখার মতোই। এখানে কোনো নতুনত্ব বা অসাধারণত্ব বা বিপ্লবী জীবনবার্তা নেই। কন্যা অ্যালেইদা বড়ো হয়ে বাবার চিঠির কথা ভেবে পীড়িত হতেন। তিনি ভেবেছেন, তার বাবা তাকে রান্নাঘরে বন্দী করে রাখতে চেয়েছেন আর ভাইকে নিয়ে চাঁদে বেড়াবার কথা ভেবেছেন। বাবা হয়তো ভাইটিকেই বেশী ভালোবাসতেন। তবে কিউবার মন্ত্রীসভার কক্ষে গিয়ে তিনি যখন দেখতে পান, মন্ত্রীসভার কেবিনেটে যেখানে চে’ বসতেন সেখানে টেবিলের কাঁচের নিচে চারটি ছবি, তার তিনটিই চে’ এর সঙ্গে অ্যালেইদা তখন অ্যালেইদা ভাবেন, বাবা তাকেই বেশী ভালোবাসতেন।

বেশী ভালোবাসলেই মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়ে যায় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবার জন্যে খাকতে হয় শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ আর মানুষের প্রতি যুক্তিযুক্ত আচরণভঙ্গী বা বার্তা। কন্যা অ্যালেইদার প্র্রতি বাবা চে’ এর এমন অনুভূতি ছিলো না। ছিলো ভালোবাসা। লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা থেকে বেরোতে পারলে চে’ নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার দুটি চিঠি তার মেয়ে সন্তান আর ছেলে সন্তানকে লিখতে পারতেন না।

মনে রাখতে হবে এমন ভালোবাসার মধ্যে স্বৈরতা থাকে, শ্রদ্ধা থাকে না। বাবারা কন্যা সন্তানদের ভালোবাসেন অর্থাৎ স্বৈরশাসন অথবা নিজের মতকে কন্যার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন; বরেরা বউদের ভালোবাসতে পারে অর্থাৎনিজের মত চাপিয়ে দিয়ে স্বৈরশাসনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠতে পারে, যেখানে শ্রদ্ধা থাকে না। এটিকে ভালোবাসা বলে, নাকি নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্যে ভালোবাসার মোড়কে আসলে স্বৈরতন্ত্র! মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হলে, মর্যাদা দিতে হলে ভালোবাসার সাথে অবশ্যই শ্রদ্ধার বিষয়টিও থাকতে হবে।

শেয়ার করুন: