সুমন্দভাষিণী: ছোটবেলাতে যখনই কবিগুরুর ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানটা শুনতাম, মনে হতো আমার জন্যই বুঝি ঊনি তা লিখে গেছেন। আমার সব কষ্ট তখন উবে যেত। চারপাশে সব মানুষের ‘অসুন্দর’ বলার প্রতিযোগিতাটা তখন বেমালুম ভুলে কৈশোরের চপলতায় মেতে উঠতাম। আর আজ জীবনের এতোগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসে শুনছি, আমি কত সুন্দর, কত স্নিগ্ধ। বাহ্, এই শব্দমালাগুলো যদি সেই কৈশোরে শুনতাম মা-ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে, তাহলে আস্থার জায়গাটা হয়তো অনেক বেশি পাকাপোক্ত হতো আমার। এ সমাজ জানে, কিভাবে একটি মানুষকে তিলে তিলে দুর্বল করে দিতে হয়। সবল হতে গিয়ে সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে যায় আমাদের।
সেদিনই এক অনুজ সাংবাদিক ভাই লিখলো, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তার পছন্দ গায়ের রংয়ের কারণে। সে লিখতে চাইলো, কোনদিক দিয়ে খালেদা-হাসিনার চেয়ে এগিয়ে আছেন। ভাইটির কথা হলো, গায়ের রংয়ের কারণে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে উনি এগিয়ে আছেন। এটা কেবলমাত্র এই অনুজ ভাইয়েরই কথা না। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক সহকর্মীকেই খালেদা জিয়ার গায়ের রংয়ের কারণে ছোক ছোক করতে দেখেছি। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিছিয়ে গেছেন এই একটা কারণেই। কী অদ্ভুত তুলনা তাদের! মেয়েদের সৌন্দর্য বর্ণনায় প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী নেত্রী কেউই ছাড় পান না, আর আমরা তো কোন ছার। আমরা অনেকেই তখন সেই অনুজকে আক্রমণ করেছি, শেষপর্যন্ত সে স্বীকার করেছে যে, ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু আজ যত সহজে কারও কথার প্রতিবাদ আমরা করি, ৩৫ বছর আগে তো তা পারিনি, ফলে এক ধরনের মনোবৈকিল্য ঠিকই গড়ে উঠেছে নিজের ভেতর, কালো রংয়ের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছি প্রতিনিয়ত। হেরে গেছি বাসারই সবচেয়ে কম জানা, লেখাপড়ায় খারাপ করা, কোটরাগত অক্ষিসদৃশ কোন মেয়ের কাছে তার উজ্জ্বল গায়ের রংয়ের কারণে, আর তার সবকিছু মেনে নেয়ার প্রবণতার কারণে ভাল মেয়ের তকমাও জুটে গেছে সহজেই, যেখানে প্রতিবাদী আমি মার খেয়েছি নিরন্তর। কখনও হাতে, কখনও মুখে, কখনও মানসিকতায়।
আমাদের এই সময়ে কবিগুরুর কৃষ্ণকলিদের অভাব নেই। তারা যেমন সুন্দর শরীরে, তেমনি মনে ও মননেও। কয়জনের নাম বলবো? অসাধারণ গুণে গুণান্বিতা একেকজন। কই কোথাও তো কেউ থেমে নেই। না জীবনে, না ক্যারিয়ারে। আবার এই সময়েও শুধুমাত্র কালো হওয়ার কারণেই কোন মেয়ের বিয়ে হয় না, ভেঙে যায় বিয়ে। সবই হয়, হচ্ছে। আর আমিও অনেকের চোখে সুন্দর হই, মিষ্টি হই। এই ভাল লাগাটার সাথে সাক্ষাত হয়েছিল আজ থেকে ২৭ বছর আগে, বিদেশ যাওয়ার পর। ফর্সা দেশের মানুষগুলো আমাকে দেখে হা-পিত্যেশ করতো কেন তাদের গায়ের রং আমার মতোন আগুন লাগা নয়, কেন তারা আমার মতোন সুশ্রী নন, কেন তারা আমার মতোন আকর্ষণীয়া নন। প্রথমদিকে তাদের এসব কমপ্লিমেন্টকে সহজে নিতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকে কাছের মানুষগুলোর এতো অবহেলায় বড় হয়েছি যে, বিশ্বাসটুকুও কাজ করতো না। কিন্তু পরে যখন অনেকের মুখেই শুনলাম, তখন একদিন স্পষ্ট মনে আছে, হোস্টেলের রুমের দরজা বন্ধ করে বড় আয়নার সামনে নিজেকে মেলে দিয়ে দেখেছিলাম, আমার সৌন্দর্য আসলে কতটুকু! পেয়েও ছিলাম।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেছি নিজেকে বার বার। চোখ সুন্দর, চুল সুন্দর, দেহের গড়ন সুন্দর, কোথাও কোন খুঁত নেই, উন্নত বুক, ২৪ কোমর, ৩৩ নিতম্ব, পা-উরু সন্ধিক্ষণ মোলায়েন-মসৃণ, মন সুন্দর, কবিতা পড়ে যে মন, যে মন গান শোনে, যে মন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সবই যেন দেখতে পেলাম জীবনে প্রথমবারের মতোন। খুঁতগুলোও সামনে এলো তখন। নিজেকেই নিজে সমালোচনা করলাম। খুঁতখুঁতে, ঝগড়াটি-জেদি, হিংসুটে, অন্যায় মাথা পেতে না নেয়া, সো-কলড ‘লক্ষী-সুবোধ’ মেয়ে আমি নই, আমার নিজের মতামত আছে, কেউ কোনকিছু চাপিয়ে দিতে পারে না, ধর্ম নিয়ে আলাদা মতামত ততদিনে প্রবল হয়েছে, প্রচণ্ড দেশ-সচেতন, স্পষ্টবাদী (যে কারণে ভাইয়েরা ভীষণ ভয় পেত), আরও কি কি যেন। আর সুন্দরের খুঁতও পেলাম। সামনের দাঁতটাতে ফাঁক, একটু উঁচু। যে হাসিতে গালে টোল পড়ে, সেই হাসিতেই আবার ফোকলা দাঁত বেরিয়ে যায়। এটাই কী তাহলে অ-সৌন্দর্যের মূল কারণ? ভেবে পাই না। সবচেয়ে বড় খুঁত তাহলে গায়ের রং? শ্যামলা বরণ মেয়ের আবার রূপ কিসের?
সবচেয়ে বড় সমসস্যাটা হয় বড় ভাইয়ের বিয়ের পর। গায়ের রং ফর্সা দেখে বৌ আসে বাসায়। তার বিষন্ন চেহারা, কোটরাগত অক্ষি এবং শ্বশুরবাড়ির কাউকে আপন না করার দুর্গুণগুলো কারও চোখে পড়ে না। সব ফর্সায় ধুয়ে যায়। সেইসময়ে ছোট্ট আমিটি ভীষণভাবে সাফার করি বড়ভাবীর অসম্ভব রকমের অবহেলায়। বড় ভাই তখন অন্ধ। নিত্যনতুন বাণী নাজেল করেন বড়ভাবী এবং তার পরিবারের অগ্রজরা। একটা উদাহরণ দেই, ‘উঁচ কপালি, চিরল দাঁতি, পিঙ্গল মাথার কেশ’…..নিজের উঁচু কপাল, চিরল চিরল দাঁত, আর মাথার পিঙলা কেশ নিজেকে বড্ড বেশি ‘অলক্ষী’ ভাবাতে শুরু করে। আরো আছে, মেয়েদের পা নাকি হয় পদ্মিনী, শঙ্খিনী। মিলিয়ে দেখি, আমার পা যে আকৃতির তাতে খারাপটাই আছে। সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় মাথায় এগুলো গেঁথে যায়। পড়ালেখা বাদ দিয়ে মেলাতে থাকি নিজেকে, আর কিভাবে ‘লক্ষ্মী’ করে তোলা যায়, সেই চিন্তায়ও অস্থির হই।
কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে দৃশ্যে আবির্ভাব ঘটে বড় ভাবীর ছোট বোনের, যে আমার চেয়ে বছর দেড়েকের বড়। একসাথেই পড়ি। তার গায়ের রংও ফর্সা। মুখভর্তি ব্রনও অসুবিধা ঘটায় না সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞায়। নাকের নিচে চোখ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও না। তার ওপর সে অসম্ভব ‘লক্ষ্মী’ একটা মেয়ে। চা চাইতেই দৌড়ে বানাতে চলে যায়। তার দুলাভাইয়ের বিশেষ নজরে সে। সময়ে-অসময়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেওয়াও প্রতিদিনের ঘটনা তখন। আমার চোখও এড়ায় না। বড় ভাইয়ের পর যে ভাই, তারও আবদার মেটায় আমাদের বাড়ির নবাগত এই ‘লক্ষ্মী, ‘ফর্সা’ মেয়েটি। আর আমি ক্রমেই দূর থেকে দূরে যেতে থাকি। নিজের বাড়িতে প্রবাসী হয়ে দিন কাটাই।
তখন আমার ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে হারিকেন দিয়ে। ভাই পড়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে, কত তার বন্ধু, কত বড় বড় মানুষজন তারা। অথচ মেয়ে দেখা হচ্ছে, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণায়। কোন স্থানীয় কলেজে পড়া হলেই চলবে। এই চলবেটা কিভাবে?
গায়ের রং ফর্সা হতে হবে, গান জানতে হবে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, বাসার কেউই বলছে না, মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হলে ভাল হয়, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হলে ভাল হয় বা গায়ের রং যাই হোক না কেন, মেয়ে পড়ুয়া হওয়া চাই, রান্না পারুক বা নাই পারুক, চোখ-নাক-গলার স্বর সুন্দর হওয়া চাই। আমি নিজেকে আবারও আয়নায় দেখি। তার মানে পাত্রীর বাজারে আমার আসলে কোন মূল্যই নেই। এই পরিবারটা তাহলে আমাকেও এইভাবেই মূল্যায়ন করে! যে আমাকে বিয়ে করবে, সেই পরিবারও এইভাবেই মেপে নিবে আমাকে!
তাহলে আর পড়ালেখায় ভাল করি কেন? শরীর সতেজ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করি কেন? দিনরাত ব্ইয়ের মধ্যে ডুবে থেকে রবীন্দ্রনাথ, মানিক, বিভূতি, আশাপূর্ণা, সমরেশ, সুনীলকে গলাধ:করণ করি কেন? পড়ালেখা বাদ দিয়ে রান্নাবান্নাটাই বরং শিখলে পারি।
একদিন দাদীকে বলেই বসি, আচ্ছা, তোমরা যে ভাইয়ার জন্য এইভাবে মেয়ে খুঁজছো, আমার তো তাহলে কোনদিন বিয়েই হবে না।
দাদী তখন অনেকক্ষণ তার মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে ছানি পড়া চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুই তো সুন্দরই আছস’। আমি বলি, ‘ছাই আছি, গায়ের রং দেখছো?’ দাদী বলেন, ‘তোর চোখ দুইটা সুন্দর’। বললাম তাকে, ‘ওই নিয়াই থাকো। নিজের বেলায় চোখ-কান বন্ধ রাখো, আর অন্য বাড়ির মেয়ের এই খুঁত, ওই খুঁত বাইর করো’।
সেই দাদী অনেকদিন হলো চলে গেছেন। আজ ভাবছি, তিনি যদি থাকতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত, উনিও আমাকে শেষপর্যন্ত সুন্দরই বলতেন। সময়টা বেশ পাল্টে গেছে আজকাল। দাদীও হয়তো পাল্টাতেন, ভরসা ওখানেই।
অসংখ্য ধন্যবাদ । ফ্যাশন কখনো এক গন্ডিতে থেমে থাকে না। নিয়মিতই গড়িয়ে চলে এটি। অনেকে ভাবে, ফ্যাশন হলো আপনার স্টাইল। ফ্যাশন আর ষ্টাইলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
বিস্তারিত, ফ্রী ডাউলোড করুন
Bangla Audio
Hindi Audio
Kolkata Audio
Hindi Video
Kolkata Video
Bangla Video
New Natok
Android Apps
অনেক ধন্যবাদ