সাগর-রুনির হত্যাকে বেচলো কারা?

Sagar-Runi-with-only-son-Meghfamily-albumসুমন্দভাষিণী: আজ তিন বছর হয়ে গেল সাগর-রুনি নেই আমাদের মাঝে। ওরা ছিল, এখন নেই। হারিয়ে কী গেছে? না, ওরা খুন হয়েছে। ওদেরকে কেউ হত্যা করেছে। কেন করেছে? ওরা কী খুব সাংঘাতিক কিছু ছিল? তাও তো না।

দীর্ঘদিন পথচলার কারণে ওদেরকে আমাদের মতোন সাধারণ মানুষ হিসেবেই তো দেখেছি। রাজনীতির ধারে-কাছে নেই, ক্ষমতার ধারে-কাছে নেই। ক্ষমতা নিয়ে বা রাজনীতি নিয়ে কখনও প্রশ্ন তুলতেও দেখিনি। আমরা যখন নানা সময়ে, নানা আন্দোলনে জড়িয়েছি, ওদেরকে নির্লিপ্তভাবে কাজ করে যেতে দেখেছি। তাহলে খুন হলো কেন? কার পথে ওরা কাঁটা বিছিয়েছিল? আজ তিন বছরেও কোনো প্রশ্নেরই উত্তর আমরা পাইনি। সাংবাদিক সহকর্মীরা যারাই এ নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেছে, কোনো অজ্ঞাত কারণে তারা সেখান থেকে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছে, আর এগোয়নি তারা। এ নিয়ে মুখও খোলেনি আর। উপরন্তু তারাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজনের সাথে প্রমোদবিহারে গেছে। সেখান থেকে ফিরে ওরা ভুলে গেছে প্রিয় সহকর্মীদের, ওরা ভুলে গেছে সহকর্মী দুজনের রেখে যাওয়া সন্তানকে দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা।

ওরাও মুখ খুলবে না কোনদিন, এ আমরা বুঝে গেছি। গত তিন বছরে আশেপাশে সহকর্মীদের অধিকাংশকেই আমার খুনি বলে মনে হয়েছে। একেক সময় একেকজনের মুখ মনের আয়নায় বসিয়ে বুঝতে চেয়েছি, খুনটা সেই করেছিল কিনা! নিজেদের সীমিত আড্ডায় যখনিই কথা উঠেছে, আস্তে করে গলার স্বর নেমে এসেছে আমাদের। এক তথ্য, দুই তথ্য, তিন তথ্য, সবমিলিয়ে আসলে কোন তথ্যই নেই আমাদের কাছে। যা আছে, তা কেবলই ধারণা-অনুমান আর সন্দেহ। এ নিয়ে আর যাই হোক, সাংবাদিকতা হয় না। ফলে খুনিরা দাঁত কেলিয়ে হাসে, হয়তো আমাদের সাথেই তারা চলাফেরা করে, নিত্য-নতুন গাড়িতে চড়ে, বিলাসবহুল বাড়িতে থাকে, এমনকি বইমেলায় আদর্শবাদী লেখা নিয়ে বইও প্রকাশ করে। কে জানে!

তবে সাদা চোখে দেখি, একদল সাংবাদিক গর্তে ঢুকে গেছে আমাদের সহকর্মী দুজনের হত্যা প্রসঙ্গে। তারা চড়া দামে বিক্রি হয়েছেন। কিন্তু কার কাছে? তাদের ক্রেতা কে? আমরা কী জানবো কোনদিন সেকথা? কেউই কী জানবে? তারা যদি মুখ না খোলেন কখনও, তাহলে জানার আর উপায় নেই।

রুনি-সাগর, এ দুটো নাম আমাদের অনেকের আত্মার সাথে মিশে আছে। একে হয়তো আমরা প্রতিদিন নাড়াচাড়া করি না, কিন্তু ওরা থাকে, হেসে-খেলে বেড়ায় মনের মধ্যে, যতটা না আনন্দ হয়ে, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘশ্বাস হয়ে। ছোট্ট মেঘ বড় হচ্ছে, তার দাঁত পড়া, ফুটবল খেলা, স্কুলের অনুষ্ঠান সবই আমাদের জানান দিয়ে যায় সাগর-রুনির অস্তিত্বের কথা। গত তিনবছরে রাতে আমার ঘরের ড্রইং রুমে আলো জ্বলে, এটাও জানান দেয়, সেই বীভৎস সময়টির কথা।

গতবছর ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখার পর এক বড় ভাই আকারে-ইঙ্গিতে সেই স্ট্যাটাস মুছে ফেলার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই ভয় আমাকে কাবু করে দিয়েছিল সেই সময়। কী এমন অপরাধ করেছি ওদের খুনের রহস্য জানতে চেয়ে, সেটাই বুঝিনি। কিন্তু সাগর-রুনি ভিআইপি হলো কবে থেকে, সেটা যদি আমাদের জীবদ্দশায় একটিবারও জানতে পারতাম!

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকালবেলাতেই খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ওদের লাশ ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। সেই রক্তের দাগ এখনও মন থেকে মুছে যায়নি। সেই দীর্ঘশ্বাস এখনও ধ্বনিত হয় নিজের ভিতরে। কেবল আমি এবং আমরা গুটিকয়জনই তা শুনতে পাই। কিন্তু যারা এই রহস্যের সমাধান করতে পারতো, তারা কেউ শুনতে পায় না। শুনবেও না কোনদিন। মেঘ কোনদিনই হয়তো জানবে না, তাদের সাধারণ বাবা-মা কিভাবে, কি কারণে অসাধারণ হয়ে উঠেছিল এই দেশে!

সাগর-রুনি এবং মেঘ, তোমরা তিনজনই আমাদের ক্ষমা করে দিও। আমরা অক্ষম, অথর্ব, ছাপোষা কেরানি মাত্র। প্রতিবাদী হলে আমাদের চাকরি যাবে, এমনকি তোমাদের মতোন প্রাণও চলে যেতে পারে, যে প্রাণ আমরা হাতে নিয়ে ঘুরছি প্রতিনিয়ত। নিকষ-কালো অন্ধকারে আমরা পথ চলেছি, যে পথের শেষে আলোকবিন্দু আমাদের থেকে আজ সহস্র-যোজন দূরে। ক্ষমতার কাছে আমরা পরাস্ত সবাই। কে যে ওদের বিক্রি করে দিল, সেটাই জানতে চেয়েছিলাম শুধু।

শেয়ার করুন: