
সাবরিনা সুলতানা: সেই ৫ নং বিল্ডিং এর আলপনা আঁকা সিঁড়ি। সিঁড়ি আছে, আলপনা ধূলোয় গড়িয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার দশা প্রায়। বিল্ডিং এর সামনের সিঁড়ির ধাপের মাঝে ছোট্ট র্যাম্পটি সেই রকমই আছে, শুধু নেই দস্যিদলের বিচ্ছুরা…সাইকেলে সাঁ করে একটানে উঠবে- নামবে। লুকোচুরিতে বিল্ডিং কাঁপাবে। সেই সিঁড়ি ঘর, সেও একই রকমই আছে।
মনে পড়ে সাবরিনা! একতলা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে এক দমে তিনতলায় রিপাদের বাসায় বেল চেপে আবার লাফিয়ে চারতলায়। সাবরিনাদের দরোজার বেল চাপতেই দে ছুট। ঘুর দৌড় নিচতলায়। মৌরিদের দরোজার বেল কে আগে চাপবে! কথা নেই, বার্তা নেই সামনের বিশাল মাঠে আচমকা চড়ুইভাতির ছুটোছুটি। ডিমের খোসায় ভাত রেঁধে সেই নিয়ে কাড়াকাড়ি. . . রুবিনা, ন্যাপি, ডিটি যারা বয়সে বেড়ে উঠেনি। একটু লম্বা হয়ে ফ্রক ছেড়ে দেয়া আপুরা বারান্দার গ্রিল ধরে চেয়ে দেখতো আমাদের।
কানামাছি, বৌচি, গোল্লাছুটের সময়গুলোতে যখন সাবরিনাকে খেলা থেকে বাদ দেয়া হতো সেই রকমই মন খারাপ হতো কি আপুদের?! আর সেই টিলাগুলোর কি কান্না পেয়েছিলো যেখানে জায়গা করে নিয়েছে আজ ইট কাঠের ছাউনি? রোজ পাহাড়-পাহাড় খেলা দারুণ জমে উঠতো সেখানে। যদিও মাঠের বিশালাকায় আয়তন কমাতে পারে নি তাতে তেমন! ঠিক পাশেই নার্স কলোনীর পিচঢালা রাস্তা যেখানে একদা ছিলো গা ছমছমে পড়ন্ত দুপুরগুলো। মাথায় রোদ্দুরের তপ্ততা নিয়ে নির্জন দুপুরগুলোতে এবড়ো খেবড়ো সেই ইটের রাস্তায় পথচলা। সম্ভবত কালের বিবর্তনের প্রয়োজনেই এত বছরে স্মৃতিতেই উঁকি ঝুকি দেয়া যায় বোধকরি।
মনে আছে তোর, ঐ রাস্তা দিয়ে ভর দুপুরে মাকে ফাঁকি দিয়ে মসজিদ পালিয়েছি কতো! সেই যে উলটো দিকের মাস্টার্স কলোনির মসজিদের সেই রাস্তা পালিয়ে মিনা মোনাকে নিয়ে চুপিচুপি রিপাদের বাসায়। সেখানেই একসাথে সুর করে আরবী পড়ার সুখ মসজিদে হুজুরের ঝিমুনির মাঝে আর কৈ! রিপার সাথে আড্ডা হয় না কতো হাজার লক্ষ দিন আর রাত্তির পেরিয়েছে…কতো অগুনতি কালো কালো হরফে হিজিবিজি লেখনী নীল খামে বন্দী হয়ে ধূলোয় গড়াচ্ছে আড্ডাবাজির অভাবে। তা কি জানে বা আদৌ জানবে কখনো রিপা! কখনোই জানা হবে না হয়তো তার সিলভার বেলস স্কুলের বাস থেকে নেমে দু’বেনী ঝুলিয়ে রিপা যখন বাসার দিকে হেঁটে হেঁটে ফিরতো সাবরিনা রোজ সে সময়টাতে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতো তাকে।
আচ্ছা মন খারাপের ঝাঁপি তুলে রেখে এবার তোকে বলি রমজানের সময়ের ছোট ছোট শখের স্টলগুলোর কথা। মনে আছে তোর?
এই সবুজের মাঠেই, নিজ হাতে বানানো ঈদ কার্ড, লজেন্স আরো কত্তো কি! যার যত বিক্রি. . .তারপর ঈদে দল বেঁধে আন্টিদের হাতে সেমাই ফিন্নি খেতে বেড়িয়ে সেলামি প্রাপ্তি। আহা. . . কচকচে নতুন দুই/এক টাকা নোটের ঘ্রাণ কোরবানি ঈদে নেই বলে আমাদের কলোনীর বাচ্চাদলের আফসোস। সাবরিনা তোর মনে আছেরে, একবার কোরবানীর ঈদে ঝুম বৃষ্টি হলো। সে কি গর্জন আকাশের! উড়িয়ে নিয়ে যাবে গোল হয়ে একে অপরকে ঘিরে রাখা আমাদের কলোনির সমস্ত বিল্ডিংকে যেনো। তাদের একতাও কম কি, ভাঙবে সে কোন শক্তি! কিন্তু বাচ্চাদলের যে বেজায় মন খারাপ, সিঁড়ি ঘরের বাইরে বেরুতেই দেবে না বড় বড় মানুষের দল। তারা কি বুঝবে বাতাসের সাধ্যি নেই আমাদের দৃঢ় একতা ভাঙার!
সেই আমাদের কলোনি! চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের সাথে লাগোয়া সেই আশির দশকের সদ্য গজানো এই বিল্ডিংগুলো। সেই ঐতিহাসিক ৫নং বিল্ডিং এর চারতলার নতুন তৈরি ফ্ল্যাটবাসায় কন্যার জন্মের ১৭ দিনের মাথায় যাত্রা শুরু। আনারি হাতে সদ্য কৈশোর পেরুনো মায়ের নতুন সংসার। বাবার নতুন চাকরি। আর বিল্ডিং এর নতুন শিশু সেই কন্যাকে নিয়ে সিদ্দিকা নানু, ফরহাদ আন্টিদের ঘরে মাতামাতি…রিপা এলো। মৌরি এলো। আরো কতোজন এলো গেলো। ধীরে ধীরে কলোনিও পুরনো হলো। পালটে গেলো অনেক কিছুই।
কিন্তু আছে তো আমাদেরই সেই কলোনি . . . তাই না?! এমনই থাকুক প্রার্থনায়!