তানিয়া মোর্শেদ: মনটা কিছুতেই ভালো থাকছে না। সমাজ, দেশ, পৃথিবী আজ অমানুষদের দখলে। এবার দেশে কোনো এক ব্যাপারে আলোচনায় বলেছিলাম যে, আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ করবার জন্য একটি শব্দ খুঁজছি। কেন জানি না গালি হিসাবে বাংলায় প্রাণীর নাম বলা হয়। ছাগল, কুকুর, শূকর, গাধা, খচ্চর, সাপ ইত্যাদি থেকে শকুন। দেশের কথা বোঝাতে প্রিয় কবিতায় কবি লিখেছেন, দেশের পতাকা আজ খামচে ধরেছে পুরনো শকুন।
মানুষের নীচতা, হিংস্রতা, বর্বরতা বোঝাতে প্রাণীদের অহেতুক টেনে আনা। মানুষ বাদে প্রাণী জগতের হিংস্রতা শুধুমাত্র খাদ্য সংগ্রহের জন্য। ছোট ভাই বলে বসলো, “অমানুষ”। তারপর থেকে রাগ প্রকাশ করবার জন্য ‘অমানুষ’ শব্দটাই ব্যবহার করবো ভাবছি। অন্য প্রাণীর নাম ধরে শুধু তাদের অপমানই করা হয় না, শিশুকে শেখানো হয় সেই প্রাণীটিকে ঘৃণা করতে। হয়ত এই কারণেই বাংলাদেশে ছোটবেলা থেকেই অনেক নিষ্ঠুর আচরণ করে মানুষ প্রাণীদের সাথে। অন্য কোনো দেশে কি কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে অন্যান্য যে কোনো প্রাণী দেখলেই অনেকেরই ইচ্ছে করে কোনো না কোনো নিষ্ঠুর আচরণ করতে?
টিভিতে, কাগজে বৎসরের পর বৎসর দুর্ঘটনা, হত্যা ইত্যাদিতে আহত, মৃত ব্যক্তির ছবি দেখতে দেখতে বাংলাদেশের মানুষের সংবেদনশীলতা কি কমে যায়নি? যদি নাই যেতো তাহলে এতগুলো মানুষের দগ্ধ শরীর দেখেও মানুষ কিভাবে ব্যক্তিগত, সামাজিক উৎসব অব্যাহত রাখে?
জীবন কোনো কিছুর জন্যই থেমে থাকে না। কিন্তু একটুও যদি না থমকায় তাহলে মানুষ আর অমানুষের পার্থক্যটা কোথায়? সবই চলে, চলবে কিন্তু আচরণে এটুকুও কি থাকবে না যে আমি, আমরা থমকে গেছি অল্পক্ষণের জন্য হলেও?
ক’দিন ধরে দেশ থেকে আনা বই পড়বার চেষ্টা করছি। শাহাদুজ্জামানের বেশ ক’টি বই এনেছি। তাঁর লেখা আগে পড়িনি। একটু আগে “আয়নার ওপিঠ লাল” গল্পটা পড়ে হঠাৎ নিজের কেইন নিয়ে হাঁটবার দিনগুলো ছুঁয়ে গেলো!
হ্যাঁ, আমিও সে সময় গল্পের চরিত্রের মত অন্যের চোখে নিজেকে দেখেছি! কেউ সরাসরি জিজ্ঞাসা করতো না (যাদের জানা ছিল না) কি হয়েছে তোমার? কিন্তু আড় চোখে কেউ কেউ দেখেছে। আর বেশীর ভাগই ভাব করেছে আমার কেইনটা দেখেনি! মনে আছে, আমি মাথা উচুঁ করে (সব সময়ই তাই) কেইন নিয়ে দীপ্তকে স্কুল থেকে আনতে যেতাম। শুধু একজন জিজ্ঞাসা করেছিল। তার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল।
দগ্ধ হওয়া মানুষ যারা বেঁচে থাকবেন মুখে, শরীরে অসহ্য স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে তাদের কথা ক’জন ভাবছি?!ক’জন পাবেন প্লাস্টিক সার্জারি? দুর্ঘটনাবশত এটা হওয়া আর মানুষের করা জঘণ্য অপরাধের কারণে হওয়া, দুটোই মেনে নেওয়া কঠিন।
তারপরও ভাবি, মানুষ কেন মানুষের জীবন এভাবে বদলে দেবে? জীবনের এমনিতেই কত ঘাত-প্রতিঘাত আছে। সেখানে মানুষ কেন হবে মানুষের জীবন বদলে দেবার কারণ? দগ্ধ হবার যন্ত্রণা কিছুটা অনুমান করা যায় যারা রান্না ঘরে নিয়মিত বা অনিয়মিত। রান্না করতে যেয়ে হাতে আগুনের তাপ লাগা বা তেলের ছিটে লাগবার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। কারো কারো হয়ত আগুন বা গরম পানিতে পুড়বার অভিজ্ঞতাও আছে। গরম পানিতে পুড়বার অভিজ্ঞতা আছে আমার (গৃহকর্মীর অসাবধানতা বশত) সেখান থেকে ধারণা করতে পারি কি নারকীয় যন্ত্রণা পাচ্ছেন কতগুলো মানুষ!
প্রশ্ন, কিসের জন্য? কার জন্য? কেন এখন পর্যন্ত অপরাধীদের (যাদের ছবি দেখা যাচ্ছে আগুন দেবার) ধরা হচ্ছে না? কবে বন্ধ হবে এ অমানবিক আচরণ?