
নাহিদ সুলতানা: আয়েশা আক্তার জাহান- ১৯৯৫ সাল থেকে গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত। গত ২০ বছরে গার্মেন্টেসের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ, অ্যাগ্রোবেজড বিজনেস, ফুড বিজনেস, মিডিয়া, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছেন এবং দিন দিন আরও নতুন ব্যবসার সাথে জড়িত হচ্ছেন। বর্তমানে তার ব্যবসায়ি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। রেনেসাঁ গ্রুপের পরিচালক হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এছাড়াও তাঁর আরেকটি পরিচয় হচ্ছে তিনি বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী।
আপনার বেড়ে উঠা , পরিবার, পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাই।
………আমার বাবার বাড়ি রাজশাহীতে। আমরা পাঁচ ভাইবোন। আমার আব্বারা ছিলেন সাত ভাইবোন। আমার চাচা ফুফু সবাইকে আমার আম্মাই মানুষ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার পুরো পরিবারের থেকে বন্ডিংটাই শিখেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আমার পড়াশোনা করতে অনেক ভালো লাগে কিন্তু পরীক্ষা দেয়া আমার কখনোই ভালো লাগে না। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে আমার অনেক ভালো লাগে। স্কুল কলেজ শেষ হবার পর আমি ইতিহাসে মাষ্টার্স করার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে MBA করেছি। আমি তিন সন্তানের জননী। আমার সন্তানরা মাশাল্লাহ মেধাবী। আমার স্বামী সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আছেন। সংসারের কাজ এবং আমার অফিসের কাজ দুটোই আমি পারদর্শিতার সাথে সামলাচ্ছি। একজন নারী হিসাবে আমি গর্বিত এবং নারী একজন ক্ষমতাসীন মানুষ এটা সবাইকে মানতে হবে।
আপনার কাজের ক্ষেত্র , রোকেয়া foundation এবং অন্যান্য কাজ নিয়ে যদি বলেন।
……..২০১৩ সালে আমি রোকেয়া ফাউন্ডেশন শুরু করি। এদেশের অসহায় এবং এতিম মেয়ে শিশুদের জন্য। শুরুটা হয় গাজীপুরের একটি শেল্টার হাউসে চার জন বাচ্চা নিয়ে, যেখানে এখন এক বছরের মধ্যে ৫৩ জন মেয়ে শিশু রয়েছে। যাদের বয়স চার থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এই শেলটার হাউসে বাচ্চারা বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, শিক্ষা এবং আনুষঙ্গিক অন্য সবধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য এই শেলটার হাউসের পাশের একটি সরকারি স্কুলে যাচ্ছে। তাদের আনা-নেয়ার জন্য রোকেয়া ফাউন্ডেশনের নিজের পরিবহন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে এই শেলটার হাউসের ধারণ ক্ষমতা ৬০ জন। যা প্রতিবছরই বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এছাড়াও রোকেয়া ফাউন্ডেশন ঢাকার বনানী বস্তিতে একটি ফ্রি স্কুল এবং রাজশাহীর গোদাগাড়িতে একটি ফ্রি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনা করছে, এর পাশাপাশি ১০০ জন দরিদ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীকে (এককালীন) শিক্ষা বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সকল বিভাগে শেলটার হাউস করার পরিকল্পনা রয়েছে রোকেয়া ফাউন্ডেশনের এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রম (যেমন, এসিড সন্ত্রাস, যৌতুক, বাল্য বিবাহ, নারী অধিকার, শিশু নিরাপত্তা ইত্যাদি) দেশব্যাপী জোরদার করা হবে।
সাধারণত আমরা দেখি যে আমরা নারীরা বিয়ের আগে পিতার নাম ও বিয়ের পর স্বামীর নাম নিজের নামের সাথে ব্যাবহার করি। বিষয়টা এমন যেন নারীর নিজস্ব নাম থাকতে নেই। কিন্তু আপনি এর বাইরে। এর কারণ কি ?
……আমি আমার স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ কারণ উনি কখনো আমার নামের উপর উনার নাম চাপিয়ে দিতে চান নাই এবং উনি সবসময় চেয়েছেন আমি যেন আমার নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারি। আমি নিজেও আমার নামটা বদল হোক সেটা চাইনি। আমাদের দুজনের বোঝাপড়ার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
নারীর অবস্থা ও অবস্থানের জন্য সরকারি/বেসরকারি ও সামাজিক কি ধরনের উদ্যোগ আরও জরুরি বলে মনে করেন? আপনি নিজে এর জন্য কিভাবে কাজ করছেন?
…….নারীর অবস্থা ও অবস্থানের জন্য প্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হলো নিরাপত্তা, আর তা যদি না থাকে তবে নারীর জন্য কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে। সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগ আরও বেশীএদিকে নজর দিতে হবে। নিরাপত্তা আসলে নারী – পুরুষ উভয়ের-ই দরকার। নারীর জন্য বেশি দরকার। নিরাপত্তা হলেই নারী ঘরে ও বাইরে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে। এর জন্য রোকেয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি দেশব্যাপী কার্যক্রম চালু করেছি, যেখানে সমাজের পুরুষদেরকে আমি আরো সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পুরুষদের সচেতনটা বাড়ানো গেলে নারী সচেতনটা এমনিতেই আসবে। আমাদের দেশটা পুরুষ প্রধান সমাজ। পৃথিবীর অন্য দেশেও এটা আছে। কিন্তু তারা অনেক কাজ করেছে এই বিষয়ে। আমাদেরকেও আরও কাজ করতে হবে। এবং এই কাজটা সমাজের সকলে মিলে করতে হবে। পুরুষকে আরও অনেক বেশি এগিয়ে আসতে হবে। নারীর লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তা থাকতে হবে। সঠিক জায়গায় বসাতে হবে যোগ্য লোককে। প্রচুর টাকা থাকতে হবে বিষয়টা এমন নয়। নিজে সৎ ও ঝুঁকি নেয়ার সাহস থাকাটাই এখানে জরুরি।
আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক system এ যখন নারীর একক সত্ত্বা গড়ে উঠে না তখন নারীর সাফল্য অর্জন উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব ?
……..যে কারও সাফল্য তখনই আসে যখন যে তার কাজের প্রতি সততা ও একগ্রতা নিয়ে কাজ করে। এখানে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সেরকম কোন পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না। যেহেতু আমাদের দেশে এখনো মেয়েদের নিয়ে বাবা-মা, স্বামী তথা সমাজ ততটা বৃহৎ চিন্তা করতে পারে না এবং মেয়েরা ঘরে বসে সংসার সামলাবে, এটাই স্বাভাবিক মনে করা হয়। তাই নারীর জন্য কাজ করা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই পুরুষের চাইতে বেশি থাকে। কিন্তু একজন নারী যদি তার কাজকে মূল্যায়ন করতে পারে এবং লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য অটল থাকতে পারে তাহলে সাফল্য অনিবার্য। নারীর আত্মবিশ্বাসের মাত্রা জোরদার করতে হবে। নারীর চোখে বিশ্ব দেখতে হবে।
আমরা জানি আপনার স্বামী শাহরিয়ার আলম বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। সক্রিয় রাজনীতিতে আপনি কতটা আগ্রহী? আমরা দেখি যে নারীরা রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় নন। এর কারণ কি বলে মনে করেন?
……রাজনীতিতে নামার এখন পর্যন্ত আমার কোন আগ্রহ নেই। তবে আমি রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। আমার পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত। আমি রোকেয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেশের – মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
আপনি একজন উদ্যোক্তা হিসাবে মালিক- শ্রমিক সম্পর্ক কে কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন ? তাজরিন , তুবা , রানা গার্মেন্টস ইত্যাদিতে যে শ্রমিক হত্যাকাণ্ড ঘটলো , আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসাবে এটাকে কিভাবে দেখবেন?
……মালিক শ্রমিক সম্পর্ক অবশ্যই সুন্দর ও স্বাভাবিক হওয়া উচিত। আমাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনরকম শ্রমিক আন্দোলন হয়নি। এর কারণ আমরা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারগুলোর ব্যপারে অত্যন্ত সজাগ। আমরা কখনই চাই না যে শ্রমিকরা কোনভাবেই বঞ্চিত হোক। তাঁর প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও অর্থ তাঁরা পাবেন এটাই তো হওয়ার কথা। তাজরিন, তুবা, রানা প্লাজা সহ অন্যান্য ফ্যাক্টরিগুলোতে যে দুর্ঘটনা হয়েছে তার জন্য আমি মালিক পক্ষের অসচেতনতাকেই দায়ী করব। মালিক পক্ষ সতর্ক থাকলে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যায় । সব ফ্যাক্টরির মালিকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা শ্রমিকদেরকে মানুষের মর্যাদা দিন।
নারী উদ্যোক্তা ও সমাজ সেবার জন্য আপনি InternationalUunitedWomenCongress Award পেয়েছেন। আপনার কেমন লাগছে?
……নারী উদ্যোক্তা এবং সমাজসেবার জন্যে আপনাদের দোয়ায় আমি কিছু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছি। আমি আরও অনেক কাজ করতে চাই এবং আমি আশা করব ভালো কাজে আমরা সকলের পাশে থাকব এবং সবাইকে ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করব।