ফারহানা রহমান: মানুষ আসলে কি চায় তার জীবন থেকে? এ পৃথিবীতে ছয়শ কোটি মানুষ, নিশ্চয়ই সবার চাওয়া-পাওয়া আলাদা। কোথাও কোথাও, কিছু কিছু চাওয়ায় কারো কারো মাঝে মিলও আছে হয়তো বা, সবার জীবনেরই নির্দ্দিষ্ট একটা চাওয়া নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমি কি করে জানবো কে, কি চায়?
তবে আমি একলা হতে চাই। গত ২৪ বছর ধরে আমার শুধু এই একটাই চাওয়া, সেটা হচ্ছে একলা হতে চাওয়া। এই ২৪ বছরের প্রত্যেকটি মূহূর্তে আমি শধু এই একটি জিনিসই চেয়েছি। তবে ছোটবেলায় আমি কিন্তু কিছুতেই একলা হতে চাইতাম না, এমনকি কিছুক্ষণের জন্যও আমি একলা হতে ভয় পেতাম।
ভূতের ভয়, খারাপ মানুষের ভয়, অজানা আশংকার ভয়, এমন নানা রকম ভয়ে ভয়ে কেটেছে আমার জীবনের প্রথম আঠারো বছর।
একই স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ায় বন্ধু-বান্ধবীর সংখ্যা অনেক ছিল। ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় প্রথম আমাদের এক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে থেকে বাসায় ফিরে এসে আমার সেকি কান্না! আহা! আমার কবে বিয়ে হবে? সেই শুরু।
এরপর যখন যার বিয়ের খবর শুনি আফসোস করতে করতে মরে যাই। এভাবে কলেজে ওঠেও কিছু কিছু বান্ধবীর বিয়ের খবরে আমরা কয়েকজন বান্ধবী হা-হুতাশ করে মরতাম। মনে মনে ভাবতাম আমার বোধহয় জীবনে বিয়ে হবে না।
বান্ধবীদের প্রায় দুঃখ করে বলতাম, “আচ্ছা শুনেছি আল্লাহ নাকি পৃথিবীতে সবাইকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছে, তো আমার তো কোন জোড়া খুঁজে পাচ্ছি না, আমার কপালে বোধহয় বিয়ে নাই বুঝছিস”? আমার কথা শুনে বান্ধবীরা হাসাহাসি করত…হায়রে তখন যদি জানতাম সর্ষের ভিতরেই ভূত।
এভাবে হাপিত্যেশ করতে করতেই একসময় বিয়ে হলো। এখনো মনে পড়ে, বিয়ের দিন আমি কি হাসিই না হেসেছিলাম। সবাই আমার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছিল। কেউ কেউ বললো, একটু চুপচাপ দুঃখী-দুঃখী ভাব নিয়ে থাকতে। কে একজন তো বলেই বসলো, “ যত হাসি তত কান্না বলে গেছেন রাজেশ খান্না ( রাম সন্না)”
তো বিয়ের পরের ২/১ মাস তো স্বপ্নের ঘোরেই কাটলো। তো যা হয় আর কি, যাদের ঘোর লাগতে সময় লাগে না, তাদের ঘোর কাটতেও সময় লাগে না। আমি তখন আমার আগের সেই উচ্ছল বাঁধভাঙ্গা জীবনে একটু একটু ফিরে যেতে চাই। কলেজে ক্লাস করতে চাই, এটা বলতে গেলে শুনতে হয়, ক্লাস করার দরকার কি, পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই তো হয়, আর আমি তো কোন চাকরিজীবী মহিলা বিয়ে করিনি, গৃহবধুদের এত পড়ালেখার দরকার কি? বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে, আড্ডা দিতে চাই, তো শুনতে হয় বিয়ের পর এত বন্ধু-বান্ধবীর কি দরকার? হাজবেন্ডই তো বন্ধু…। সিনেমায় যেতে চাই তো শুনতে হয়, কী বাচ্চাদের মত সিনেমা-টিনেমা দেখা? এত বাজে সময় কোথায়? বসে বসে গল্পের বই পড়ি তো শুনতে হয়, যত সব আজেবাজে বই পড়ে মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে তিন বেলা কোরআন শরীফ পড়লে তো আখেরে কাজ হয়।
পূর্ণিমা রাতে আকাশ দেখতে চাই তো শুনতে হয় এত রোমান্টিকতা করার সময় নাই। এতসব নাই নাই শুনতে শুনতে একসময় জানতে চাই, তাহলে আমি আসলে কি করবো? আমার কাজ কি? তখন আমাকে বোঝানো হলো বিয়ের পর একটি মেয়ে শুধু ঘরের কাজ করবে, রান্না-বান্না করবে, ঘর গোছাবে, স্বামী-সন্তানের সেবা করবে, নামাজ রোজা করবে, পর্দানশিন ভাবে থাকবে, সেজে গুঁজে স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকবে, আর যেখানে যাবে স্বামীর সাথে যাবে।
এসব শুনে টুনে আমার বিয়ের নেশা ছুটে গেলো। ৪/৫ মাস পরে আমি আব্বার কাছে গিয়ে বললাম, আমি ডিভোর্স দিতে চাই। তখন আমি চার মাসের প্রেগন্যান্ট। আব্বা প্রথমেই যেটা বলল, ‘আমি তোকে বলেছিলাম পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করতে, তুই তো শুনলি না। আমি আর কি করবো সারাদিন রাত শুধু কেঁদে কেঁদে ভাসাচ্ছি, আব্বা বললো, ঠিক আছে বাচ্চাটা হোক, তারপর ডিভোর্স দিস।
জীবনে কতকিছু দেখেই হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরেছি। খুব গুণী-জ্ঞানী মানুষকে হিংসে করেছি, সুন্দরীদের হিংসে করেছি, সফল মানুষদের হিংসে করেছি, মেয়ের মায়েদের হিংসে করেছি, তবে সবচেয়ে বেশী হিংসে করি এখন পর্যন্ত তাদেরকে, যারা একলা থাকে।
প্রত্যেকটি একলা নারী ও পুরুষকে আমি যারপরনাই হিংসে করি। আমার ধারণা এরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী প্রজাতি, কারণ এদের ইচ্ছের মালিক এরা শুধু নিজেই। তাই আমি একলা হতে চাই।
যা হোক, এরপর বাচ্চা হলো ভাবলাম, এটা একটু বড় হোক, তারপর বাচ্চা নিয়ে একলা থাকবো, স্কুলে ভর্তি হলো, ভাবলাম অন্তত ক্লাস ফাইভটা পাশ করুক, তারপর মা-ছেলে মিলে বাসা ভাড়া করে চলে যাবো। ফাইভ পাশ করার পর ছেলেকে বললাম, চলো, আমি আর তুমি আলাদা হয়ে যাই। ছেলের উত্তর, তুমি যা বেতন পাও সেটা দিয়ে তুমি বাসা ভাড়া দিবা, না আমাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবা, নাকি সংসার চালাবা?”
এরচেয়ে তুমি একাই চলে যাও, আমি আব্বুর সাথে থাকি, আর মাঝে মাঝে তোমার সাথে গিয়ে থাকবো। আমি ছেলের বুদ্ধিতে আম্মার বাসায় চলে গেলাম, ততদিনে আব্বা মারা গেছে। এদিকে দিনের পর দিন আমি ছেলের জন্য কাঁদি, আর আমার ছেলেও খাওয়া-দাওয়া ঘুম সব ছেড়ে দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলো। এভাবে দ্বিতীয় মিশনও ফেইল।
এরপর ভাবলাম ছেলেটা ও লেভেল শেষ করুক, তারপর একলা থাকবো। ও লেভেলের পর, এ লেভেল। এরপর ভাবলাম ইউনিভার্সিটিটা শেষ হলেই আর আমাকে কে ঠেকাবে? এখন ভাবি, থাক না, ছেলেটার বিয়ে শাদী দিয়ে সংসারটা গুছিয়ে দেই, আর অন্তত ১/২ টা নাতিপুতি মানুষ করে দিয়েই না হয় একলা হওয়া যাবে…।
আমার একলা হওয়ার ইচ্ছের ২৩ বছর পূর্তিতে আমার ভাই-বোনদের কথা হচ্ছে, ‘তুই অবশ্যই একলা হতে পারবি, কারণ এ দুনিয়াতে প্রত্যেকেই একলা আসে আর একলাই চলে যেতে হয়, তাই তোরও একলা হতে বেশী দেরী নেই’।
তাই ভাবছি-
আর না হয় কিছুদিন অপেক্ষা করেই দেখি না কি হয়?