রওশন আরা বেগম: একটা সম্মেলন চলছে। একটি মঞ্চকে ঘিরে এই সম্মেলন তবে ঠিক মঞ্চ অধিকারের সম্মেলন নয় এটি। একেবারেই একটি ভিন্ন ধরনের সম্মেলন। এই সম্মেলনর কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। এই সম্মেলনকে ঘিরে এক সুবাতাস চারিদিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই গন্ধ সকল প্রাণীগুলোকে আজ কিছু সময়ের জন্য এক সাথে এনেছে। আজ সেই মঞ্চের গল্পই শুরু করতে চাই।
সারি বেঁধে লাইন দিয়ে সকল প্রাণীগুলো মঞ্চের দিকে যাত্রা করছে। কুকুর, বিড়াল, ছাগল, গরু মহিষ কেউ বাদ যায়নি এই যাত্রায়। শুধু বাদ পড়েছে কিছু মানব, যাদের কোন কিছু অভাব নেই দেখলে মনে হয়। আসলে অসীম অভাবে নিমজ্জিত হয়ে এক এক করে সব খেয়ে ফেলছে। বাকী আছে শুধু এই পৃথিবীটাকে খেতে। অর্থাৎ সুযোগ সুবিধা নেওয়া কিছু মানুষ যারা দুর্বলকে বঞ্চিত করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। চমৎকার এক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে সবার দাবী এক ও অভিন্ন। এখানে কিছু মানুষও এসেছে তবে তারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে সকল প্রাণীর সাথে একাত্ম হয়েছে। এরা সবাই আজ অস্তিত্বের হুমকির মুখে। নাগরিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে গায়ে গতরে কিছু কংকালসার হাড্ডি ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। এদের চোখ দুটো অনেক গভীরে চলে গেছে যে গভীরতায় কোন তল নেই। যে গভীরতা কোন তলকে স্পর্শ করে না সেই গভীরতা দিয়ে তারা কিসের যেন সন্ধান করছে। তাদের এই সন্ধানে রয়েছে অস্তিত্বের সংগ্রাম যা অন্য সকল প্রাণীর সাথে একাত্ব হয়েছে। এখানে কেউ কারোর শত্রু নয়। তাদের সবাইর দাবী এক তা হলো অস্তিত্বের রক্ষার দাবী।
এই খোলা মঞ্চে কাদের কাছে এই দাবী উত্থাপিত হয়েছে? কিছু সুবিধা ভোগী স্বার্থপর মানুষের কাছে এই দাবী উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই তথাকথিত সভ্য মানুষগুলো এই মঞ্চের সামনে নাই। তাহলে কি ভাবেই তারা জানতে পারবে এই বুভুক্ষ প্রাণের আহাকার? কোন দিনও তাদের চিৎকার ঐ সভ্য সমাজে পৌছাবে না। কারন তাদের সভ্যতার পিছনে রয়েছে এক বঞ্চনার ইতিহাস যে ইতিহাস কোন কালেই বীরগাথা গর্বের ইতিহাস নয়। তাই এই ইতিহাসের পাতা গুলো পুড়িয়ে ফেলে নতুন কোন ইতিহাস লেখা লাগবে যে ইতিহাসে থাকবে এক নির্মম সত্য প্রাণীকূলের বিলুপ্তিত ইতিহাস।
অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এক পা হারিয়ে তিন পায়ের এক কুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে অনেক কষ্টে মঞ্চে এসে আজিরা দিল। কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তার বক্তব্য উত্থাপন করে গেল। কেহ তার অর্থ না বুঝলেও সমগ্র কুকুর প্রজাতি তার ভাষা ঠিকই বুঝতে পেল। কিছু বুদ্ধিমান প্রাণী তার দেহের ভঙ্গিমা দিয়ে তারা সব বুঝে নিল। শুধু বুঝতে পারলো না তাদের প্রভু যে প্রভুর জন্য এই কুকুররা জীবন দিতে পারে। সেই প্রভুর হাতেই এই কুকুর শ্রেণী প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শুধু এক টুকরো মাংস খাওয়ার অপরাধে প্রভু তার পা কেটে দিয়েছে। এর থেকে দুঃখ আর কি হতে পারে। কুকুরের ঘেউ ঘেউ বাণীগুলো বাতাসে ভেসে অনেক দূরে চলে গেল। অবশেষে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে এক ফোঁটা চোখের জল কান্না হয়ে মঞ্চে এসে পড়লো। সেই সঙ্গে সবাই কেঁদে দিল।
আস্তে আস্তে কুকুরটি মঞ্চের থেকে নেমে গেল এবং সেই জায়গায় এবার এসে দাঁড়ালো এক অদ্ভুত প্রাণী। কেউ তাকে চিনতে না পেরে সবার একে অপরের দিকে বার বার তাকাতে থাকে। এরা সবাই আজ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। তবে এখন এই মঞ্চে কি অদ্ভুত অস্তিত্ব এসে হাজির হয়েছে! সবাই অধীর আগ্রহ সহকারে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকলো, কিন্তু এই অদ্ভুত প্রাণীর মুখ থেকে কোন ভাষা বা শব্দ বের হলো না। এক পা আর এক পাখা দিয়ে সে শুধু মঞ্চের উপর লাফাতে থাকলো।
অবশেষে তাকে চিনতে পারলো এক মানব সন্তান। সে চিৎকার করে বলে উঠলো আমি তাকে দেখেছি কোন এক বইয়ের পাতায়। শত বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সর্বশেষ অংশটি হলো এই প্রাণী। এই প্রজাতির সব শেষ হয়ে গেছে। তাই সে আজ বাকরুদ্ধ এক অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। লাফ দেওয়া ছাড়া আজ তার আর কোন ক্ষমতা নেই। এই সভ্যতাই তার অস্তিত্বকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। সম্মেলনের সবাই উচ্চস্বরে তখন কেঁদে উঠলো বন্ধুর এই পরিণতি দেখে। কেউ কেউ আবার বলে উঠলো এই বিলুপ্তির প্রতিশোধ নিতে চাই। অবশেষে লাফিয়ে লাফিয়ে সে দেহ ভঙ্গিমার মাধ্যমে জানালো বড্ড দেরী হয়ে গেছে, এখন তোমরাই নিজেরাই নিজের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছো। আমার জন্য দুঃখ কর না, এই বলেই মঞ্চের থেকে বিদায় নিলো।
সর্ব শেষে মঞ্চে হাজির হলো বুভুক্ষু মানুষের প্রতিনিধি। হাত পা মুখ তার ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। তাকে দেখে চিনবার উপায় নেই এই সভ্য মানুষের প্রতিনিধি। আর তার সাহায্য কারী হিসাবে মঞ্চে এসেছে আরেক কংকাল সার দেহ সর্বস্ব নারীর প্রতিনিধি। তাকে দেখলেও বুঝবার উপায় নেই যে এই দেহে এক সময় তার যৌবন ছিল। সেই যৌবন সে হারিয়ে ফেলেছে পুরুষের কঠিন কুঠার আঘাতে। নারীকে তারা ভালবাসতে জানে না। তার যৌবনটি কেড়ে নিয়ে হিংস্র পশুর মত ক্ষত বিক্ষত করে তাকে ছুড়ে ফেলেছে নর্দমায়। এটা কি মানবতার অপমান নয়? তাই সে আজ যৌবন হারিয়ে এক অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।
মঞ্চে মানব প্রজাতির এই অবস্থা দেখে লজ্জায় সবার মাথা নত করলো সবাই। কিছু সময় পর তারা সবাই একই স্বরে বলে উঠলো হে মানব জাতি তোমাদের আজ এই অবস্থা কেন? তোমরা তো সকল প্রাণীকূলের সেরা জীব হিসাবে চিহ্নিত, কে তোমাদের উপর এই অত্যাচার করার সাহস পেয়েছে? আমরা তো তোমাদের ধারে কাছেই যেতে পারি না। সভ্য মানুষের কাতারে কি তোমাদের জায়গা হয় নি? কোন অপরাধে তথাকথিত সভ্য মানবকূল তোমাদের ত্যাগ করেছে? আর তোমার গায়ে এত ব্যান্ডেস কেন? মঞ্চের থেকে এর কোন উত্তর এলো না।
অবশেষে জর্জরিত প্রশ্নের বানে তারা দুজনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। যে সমাজ মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে, যে সমাজ নারীকে নর্মদমার কীট মনে করে, সেই সমাজ কি করে মানব সমাজ হতে পারে? স্বজাতি হয়ে স্বজাতিকেই শেষ করে ফেলছে যেখানে সেখানে কার কাছে আমরা দাবী উত্থাপনে এই সম্মেলনে এসেছি? যে মানব জাতি নিজেরাই বোঝে না নিজেদের অস্তিত্ব, সেই মানবমূল কি ভাবে বুঝবে অন্য প্রাণীর অস্তিত্ব এবং অন্যের প্রজননের অধিকার? কি করে তার সৃষ্টির সেরা জীব বলে মনে করে?
সবাই এক এক করে মঞ্চ ত্যাগ করে যার যার গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলো। অবশেষে সবাই বুঝতে পারলো আসলে এটি হলো কিছু অসভ্য কুটিল মানুষের সাজানো মঞ্চ। এর মাধ্যমে কোন দিনও তারা তাদের হারানো অধিকার ফিরে পাবে না। যে জাতির মধ্যে স্বজাতিত্ব বোধই আসেনি তারা কি রক্ষা করতে পারে অন্যের অস্তিত্বকে? তাই মনে ব্যথা নিয়ে সকল প্রাণী স্থান ত্যাগ করলো।