উইমেন চ্যাপ্টার: এইতো বেশিদিন আগের কথা না। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণে যখন উত্তাল শাহবাগ আর প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়, তখনও শাহবাগে ভোর হতো ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল’ গানটি দিয়ে। কী অপূর্ব জাগরণী শক্তি যে এই গানে, যেই তখন শাহবাগে গেছে, সেই জানে। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যেত গান, মনটা শক্ত হয়ে উঠতো দেশকে অপশক্তির হাত থেকে বাঁচানোর শপথে। কী যাদু এই গানে! কিন্তু অনেকেই জানে না, এই গানের স্রষ্টা কে! দেশের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশকে ভালবেসে এগিয়ে নেয়ার গান, এটাই এই গানের স্রষ্টার বড় পরিচয়। তিনি গোবিন্দ হালদার।
অথচ আজ সকালে যখন খবর পেলাম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় উজ্জীবিত করা ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’- কালজয়ী গানের স্রষ্টা গোবিন্দ হালদার মারা গেছেন, মনটা খারাপ হয়ে গেল। কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তিনি শান্তির দেশে যাত্রা করেছেন, তাঁর এই যাত্রা শুভ হোক, মঙ্গলময়, শান্তিপূর্ণ হোক, এটাই কামনা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা তার সাড়াজাগানো গানের মধ্যে রয়েছে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’ ইত্যাদি।
ফেসবুকে অনেকেই গোবিন্দ হালদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাদের লেখনি দিয়ে। দু’একটা দেয়া হলো এখানে:
পাপলু বাঙালী লিখেছেন, ……আমাদের একে-৪৭ ছিল না, বোমারু বিমান,যুদ্ধ দানব ট্যাঙ্ক ছিল না,রণসজ্জায় সজ্জিত অষ্টম-সপ্তম নৌবহর ছিল না, আমাদের দক্ষ, গতিশীল ও পৃথিবীর অন্যতম সেরা পেশাদার সেনাবাহিনীও ছিল না,আমাদের সভ্যতা ধ্বংসকারী পরমাণুর মজুদ ছিল না। কিন্তু একাত্তরে আমাদের আধুনিক সমরাস্ত্রের চেয়ে বিধ্বংসী-ধ্বংসাত্বক কিছু ছিল। না-হলে খালি হাতে,দুই-তিন দিনের প্রশিক্ষণে কেউ এভাবে গুণগুণ করে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ বুকে ধারণ করে বিশ্বের সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তো না। চাষাবাদের জমি থেকে কৃষক উঠে ভারত সীমান্ত কিংবা আমেরিকার প্লেন ধরে নাই। অনেকেই সেই পথ ধরেছিলেন এখন সেই মানুষেরাই দেশের হর্তাকর্তা। সেই কৃষক-শ্রমিকরা পুরানো স্টেনগান কিংবা খালি হাতে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল’ বলে বলে বাংলার মাটিকে রক্ত দিয়ে কলঙ্কমুক্ত করার রাজপথে সামিল হয়েছিল। এখানের সব মানুষের একটাই ঠিকানা ছিল, একটাই গন্তব্য,একটাই স্রোত ছিল ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মরণাস্ত্র ছিল গোবিন্দ হালদাররা। এত বিধ্বংসী এত কার্যকারী অস্ত্র বিশ্ব দেখে নাই। ঝড়-ঝঞ্জা,রক্ত-লাশ,ঘরহীন-বিছানাহীন,পরিবারহীন মানুষের মুখে মুখেই ছিল সেই বিধ্বংসী অস্ত্র,সেই কালজয়ী কথামালা। আর সেই কথা সৃষ্টির মহানায়ক ছিলেন গোবিন্দ হালদার। প্রেরণা-স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বিনম্র শ্রদ্ধা সংগ্রামী।
সাংবাদিক অঞ্জন রায় লিখেছেন, বিদায় গোবিন্দ হালদার। আমি ভাগ্যবান আপনাকে স্পর্শ করতে পেরেছি। আপনি বেচেঁ থাকবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের হাত ধরে।
আমিনুল ইসলাম একটু অন্যভাবে লিখেছেন, আপনি হয়তো গান শুনেন না; গান হয়তো আপনার ভালো লাগে না; কিন্তু “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” কিংবা “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে” এই গান গুলো শুনেনি এমন মানুষ হয়তো দেশে তেমন পাওয়া যাবে না। এই গান গুলোর স্রষ্টা গোবিন্দ হালদার আজ মারা গেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকে এই মানুষটিকে সবাই শ্রদ্ধা জানাবে এটাই তো স্বাভাবিক। আজ উনি মারা গেছেন আর আমি দেখলাম এর অস্বাভাবিক দিক। এক ছেলে তার স্ট্যাটাসে লিখেছে
-একজন হিন্দু মারা গেছে তো কি হয়েছে! শ্রদ্ধা জানানোর কি হলো এতে!
যে ছেলে এই স্ট্যাটাস দিয়েছে তার কাছে গোবিন্দ হালদারের পরিচয় হচ্ছে “হিন্দু” হিসেবে। মানুষ হিসেবে না! এই ছেলে বাংলাদেশে বসবাস করে ও বাংলাদেশের নাগরিক। আশঙ্কার কথা হচ্ছে এই ধরনের মানসিকতার মানুষ জনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে বলছি এই কারনে, আমি আজকাল প্রায়ই ফেসবুকে এই ধরনের মন্তব্য দেখতে পাচ্ছি। তাহলে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? আমার ধারণা বাড়ছে রাজনৈতিক কারনে। রাজনীতিবিদরা ক্রমাগত ধর্মকে ব্যাবহার করছেন। আর সেটি একটা প্রজন্মকে প্রভাব বিস্তার করছে। এই ধরনের চিন্তাধারা একটা সময় দেশের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে বলে আমার ধারণা। রাজনীতিবিদরা যদি এক্ষুনি এসব বন্ধ না করেন, আমরা এর পর এমন একটা প্রজন্ম পাবো যারা আর কিছুদিন পর আওয়ামীলীগ বা বিএনপির কেউ মারা গেলে বলবে “একটা আওয়ামীলীগ” বা “বিএনপি” মারা গেছে তো কি হয়েছে! অর্থাৎ মানুষ গুলোর পরিচয় আর মানুষ থাকবে না। আওয়ামী, বিএনপি, হিন্দু, মুসলিমে এসে ঠেকবে। একটা প্রজন্ম কিন্ত এভাবেই বড় হয়ে যাচ্ছে। এই চিন্তা ধারার বিকাশ এখনই বন্ধ করতে হবে। নইলে দীর্ঘদিন আমাদের পুরো দেশকে পস্তাতে হবে।
১৯৩০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন গোবিন্দ হালদার।