রোজ নামচা-৩৩: আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ

women hood 2লীনা হাসিনা হক: কদিন ধরে পড়ছি ছেলেবেলায় পড়া একটা বই । লিটল উইম্যান, লেখক লুইসা মে এলকট। অনেকদিন কোনও বই পড়ছিলাম না। অন্যতম কারণ ছাপার অক্ষর পড়তে পারার মতন দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা। মেয়ের বুক শেলফ গোছাতে গিয়ে বইটি পড়তে শুরু করলাম আবার।

চার বোনের কাহিনী। জো, মেগ, বেথ আর এমি। বইটি কে অনুবাদ করেছিলেন মনে নেই এখন, তবে বইয়ের বাংলা নামটি ছিল ‘চার বোন চার মন’। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে বইটি পেয়েছিলাম। আমি যতদূর মনে করতে পারছি ক্লাস এইটে পড়ি তখন গার্লস রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে, এখনকার গার্লস ক্যাডেট কলেজ।

বিখ্যাত ‘ লিটল হাউজ অন দি প্রেইরী’ র পর এই লিটল উইম্যান বইটিই ওই বারো-চৌদ্দ বছর বয়সে আমার বয়সী মেয়েদের জীবনযাপন আর বেড়ে ওঠার কাহিনী নিয়ে দ্বিতীয় বই পড়া। যদিও বইয়ের কাহিনী আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নয়, তবু কি যেন এক ধরনের একাত্মতা বোধ করেছিলাম এই দুটি বইয়ের চরিত্রগুলোর সাথে। বিশেষ করে লিটল হাউজের লরা আর লিটল উইম্যান এর জো এর সাথে। যেন আমারই প্রতিচ্ছবি ওরা। বিশেষ করে জো এবং তার বোনদের কৈশোর থেকে ধীরে ধীরে তারুণ্যে পা রাখা যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখার অনুভব দিত।

লিটল উইম্যানের তৃতীয় বোন এলিজাবেথ ডাক নাম বেথ যখন স্কারলেট জ্বরে ভুগে মারা যায় সেই অধ্যায়টি পড়তে পড়তে বুক মুচড়ে ওঠা, গলার কাছের দলা পাকানো কান্নাগুলো অশ্রু হয়ে ঝরা! যেন আমারই ছোট বোন মৃত্যু শয্যায়! মেগ যখন প্রেমে পড়ে, সেই অধ্যায়গুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে পড়া- আমি, জলি, বাচ্চু আর জোসেফিন। লিটল উইম্যান বইটি আমরা একজন একজন করে প্রায় এক বছর আমাদের কাছে রেখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের লাইব্রেরী শিক্ষক জামান স্যার আমাদের কাছ থেকে বইটি প্রায় জোর করে ফেরত নিয়েছিলেন।

অনেক বছর পরে মেয়ের জন্য বই কিনতে গিয়ে দিল্লীর খান মার্কেটের বইয়ের দোকানে যখন মূল বইটি পেলাম, তখন আমার নিজেরই তর সইছিল না বইটি আবার পড়ার। আমার মেয়েরও প্রিয় বইয়ের তালিকায় এই বইটি রয়েছে।

আরেকটি বই মনে হয় বুঝতে পারার বয়স হওয়ার আগেই পড়েছিলাম- বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’। আমাদের ছোট খালা বিয়ে হয়ে কানাডা চলে যাওয়ার সময় তার একটি বইয়ের ট্র্যাঙ্ক আমাদের বাড়ীতে রেখে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পাওয়া এই বইটি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে কাড়াকাড়ি করে নিয়ে পড়েছিলাম।

পরবর্তীতে তিথিডোর বহুবার পড়েছি। এখনো পড়ি সময় পেলে। স্বাতীর মাঝে কিছুটা নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। বিশেষ করে, স্বাতী আর তার পিঠাপিঠি বড় বোন শাশ্বতীর মাবিহীন জীবনযাপনের বর্ণনাগুলোতে কিছু কিছু ব্যাপার যেন আমাদের বাবা ছাড়া জীবনের সাথে মিলিয়ে নিতাম।

‘তিথিডোর’ বইয়েই প্রথম জেনেছিলাম ‘জাম’ রঙের শাড়ী যা শাশ্বতী পড়েছিল গানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়। বোনেদের সাজ সজ্জার বর্ণনার অংশগুলোতে নিজেকে কল্পনা করে নিতে কোনও অসুবিধাই হতো না। কবিতাপ্রিয় তরুণ শিক্ষক আর স্বাতী যখন পরস্পরের প্রেমে পড়লো, সেখানেও কি নিজেকেই কল্পনা করে নেইনি! স্বাতীর চরিত্রের কোমলতার সাথে সাথে দৃঢ়তাও এক অদ্ভুত টান তৈরি করে তার জন্য।

গত কয়েক বছরে আর একটি বই বহুবার পড়া হয়েছে। আফগান বংশোদ্ভুত মার্কিন লেখক খালিদ হুসাইনী’র ‘এ থাউজ্যান্ড স্প্লেনডিড সানস’। বইটি লেখা হয়েছে মারিয়াম আর লায়লা নামের দুই নারীর জীবনকে কেন্দ্র করে। মারিয়ামের জন্ম অবিবাহিতা মায়ের গর্ভে। তার জন্মদাতা তার মাকে স্বীকৃতি না দিলেও মারিয়ামকে দেখতে আসতো প্রতি সপ্তাহে, বয়সে নিজের থেকে প্রায় তিরিশ বছরের বড় লোকের সাথে মারিয়ামের বিয়ে হওয়া, কাবুলে লায়লার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, আফগানিস্তানে তালিবান দখল, প্রতিবেশী তরুণ তারিকের সাথে লায়লার প্রেম এবং তারিকের সন্তান গর্ভে ধারণ, তালিবান আক্রমণে লায়লার পরিবারের সবার প্রাণ হারানো, মারিয়ামের স্বামী রাশিদের সাথে বিয়ে, সেই জীবনের নানা ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে লায়লার জীবন, স্বামীর প্রথম স্ত্রী মারিয়ামের সাথে তার যে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং কিভাবে মারিয়াম লায়লাকে কন্যাস্নেহে নুতন জীবনের দিকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে নিজের জীবন দিয়ে, এই সবই এতো সাবলীল ভাষায় লেখা যেন লায়লাদের বাড়ীতে তালিবানের রকেট শেল আক্রমণের শব্দ আমিও শুনতে পাই।

প্রতিবার পড়ি আর মারিয়াম এর জন্য কাঁদি। লায়লার সাহসে উজ্জীবিত হই। বইটির শেষ ভাগে, যখন লায়লা খুঁজে পায় তার কিশোর বেলার বন্ধু এবং প্রেমিক তারিককে, তারপরে যখন তারা তালিবানমুক্ত কাবুলে ফিরে আসে, লায়লা মারিয়ামের বাড়ী হেরাতে যায়, সেই অধ্যায়টিও কাঁদায়।

নুতন জীবনে লায়লা আর তারিক বিয়ে করে। লায়লা সন্তানসম্ভবা, পরিবারের সবাই আগামী শিশুটির নাম নিয়ে তর্ক করে, কিন্তু সে সবই ছেলে শিশুর নাম, কারণ সবাই জানে, শিশুটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার নাম রাখা হবে ‘মারিয়াম’। এই জায়গাটিও কাঁদায়।

এই তিনটি বই তিন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রচিত। নারী চরিত্র মুখ্য হলেও তাদের বাস্তবতা, তাদের জীবনযাপন সম্পূর্ণ আলাদা। তবু প্রতিটি চরিত্রের সাথে কিভাবে যেন এক হয়ে যাই। প্রতিটি চরিত্র জীবনের প্রয়োজনে কিভাবে নিজেকে বদলে ফেলে, কিভাবে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে শিখে তাই শুধু অবাক হয়ে পড়ি।

বই পড়ি, ভাবি, চরিত্রগুলোর চেহারা তৈরি করি নিজের মতন করে। নিজেকে ওই সব চরিত্রে ভাবি। আর মনে মনে বলি…

আকাশ ভরা সূর্য তারা,বিশ্ব ভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.