সুমন্দভাষিণী: হ্যাপি-রুবেল ফ্যাসাদে কে, কোন যুক্তি দেখালো তাতে কিছুই যায় আসে না আমার। অধিকাংশই রুবেলের পক্ষ নিয়েছে। ভাবখানা এমন যে, ছেলেমানুষ, একটু-আধটু ওরকম স্বভাব হতেই পারে, আর হ্যাপি হলো শোবিজের মেয়ে, তাকে যখন খুশি বিছানায় নেয়া যায়। তার মনে ভালবাসা নামের কোনো বোধ নেই।
অনেকে এমনও লিখেছেন, বেক্কল পোলাডা ফাইসা গেছে, ফাও মজা করতে গিয়ে ধরা খাইছে, টেটনা মাইয়ার খপ্পরে পরছে। বাহ, কী অদ্ভুত সব যুক্তি! তার মানে মেয়েদের সাথে ফাও মজা করা যায়, মেয়েরা প্রতিবাদ করলেই সে মুখরা, বেয়াদব হয়ে যায়!
ফেসবুকে শামীমা মিতু লিখেছেন, এই ইস্যুতে আমার পরিচিত বহু মুখোশধারী বুদ্ধীজীবি, সাংবাদিক, টকশোবীদ (অবশ্যই পুরুষ) যেভাবে মরীয়া হয়ে রুবেলের পক্ষ নিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে এটা তাদের জীবন মরনের প্রশ্ন। আমি সন্দিহান তারা যতটা না রুবেলকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তার চেয়ে নিজদের বাঁচানোর জন্যই মরীয়া হচ্ছেন। তাদের হ্যাপিরা যদি একই পথ বেছে নেন কি হবে!
মিতু মাসকাওয়াথ আহসানের লেখা উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “রুবেলকে এদেশের প্রয়োজন, হ্যাপিকে নয়। হ্যাপি যদি অস্কারজয়ী অভিনেত্রী হতেন তবে হ্যাপিকে প্রয়োজন হত”। আমি অবাক হলাম এ রাষ্ট্রে কাকে প্রয়োজন কাকে প্রয়োজন নেই, এই মাপকাঠি কে ঠিক করে দিয়েছে। বিখ্যাত কেউ, প্রভাবশালী কেউ নীতি নৈতিকতার বাঁধ ভাংলে সে কি ছাড় পেয়ে যাবে শুধুমাত্র এদেশের তাকে প্রয়োজন বলে। কী হাস্যকর!
সত্যিই তাই! যে মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত ‘সমমনা’ বা বন্ধু ভাবি, তারাই যে জেন্ডার প্রশ্নে, ধর্মের প্রশ্নে এবং জাতীয়তার প্রশ্নে কিভাবে ‘অসমমনা’ হয়ে উঠতে পারে তা হ্যাপি-রুবেলের ঘটনা দিয়ে আরেকবার প্রমাণ হচ্ছে। এই সমমনা বন্ধুরা নিতান্তই পুরুষ আমার কাছে, তাদের ‘মানুষ’ ভাবতে পারছি না, স্যরি।
কয়েকজনের পোস্ট পড়ে আমার ঘেন্নাই লাগছে নিজের কাছে। তারা যে ভাষায় হ্যাপিকে আক্রমণ করছে, তা আমার গায়েও লাগে বৈকি! আফটার অল আমিও একজন মেয়ে। এবং এসব সমালোচনা করে তারা পক্ষান্তরে ঘরের মা-বোনদেরও অপমান করছে। কয়জন জানেন যে, তারা নিজেরাও চেতন বা অবচেতন মনে এমন প্রতারণা করছেন না? বা তাদের বাবারা প্রতারণা করেনি মা বা অন্য নারীদের সাথে? প্রতারণার ক্ষেত্রে কোনো নারীই বাদ যায় না।
বলছি না যে নারীরা প্রতারণা করে না, একশ ভাগ করে। বিচার চাও তাদেরও। না তো করছি না। হ্যাপির ভুলটাও আমরা স্বীকার করেছি। সে ধর্ষণের মামলা না এনে প্রতারণার মামলা আনতে পারতো। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আ্নে এরকম কোনো প্রভিসন না থাকায় তাকে সেই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কিন্তু মূলবিষয় কিন্তু একটাই। আরেকটা ভুল করেছিল হ্যাপি, বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে বলে। এটা ওর নেহায়েত বয়সগত চপলতা বৈ তো নয়! কিন্তু এতো সমালোচনার পরও সে যে দৃঢ় এবং ঋজু ভঙ্গিমায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাতে তাকে স্যালুট না জানিয়েও পারি না।
অন্যদিকে রুবেল জাতীয় ক্রিকেটার বলে, সে আমাদের জাতীয় সম্পদ বলে, তাকে বাঁচানোর জন্যা যারা মরীয়া হয়ে উঠেছে, তাদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে। ক্রিকেটার হয়েছে বলে, হঠাৎই টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে বলে সমাজে রুবেলের একটা মূল্য সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার শেকড়? সেটা তো সে ফেলতে পারেনি। আর তা থেকেই যা ইচ্ছা তাই করার চেষ্টা করেছে সে। কাজ্বেই শ্বকাপের অজুহাত দেখিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা নেহায়েতই হাস্যকর।
এইদেশের তথাকথিত বিচারব্যবস্থায় রুবেল ছাড়া পেয়ে যাবে জানি, এবং সবাই আবার দু’গাল ভরে হ্যাপির কুৎসা রটাবে, কিন্তু মনে মনে হ্যাপিকে বিছানায় নিতেই চাইবে। আশ্চর্য পুরুষ মন! নারী মাত্রই এদের কাছে যৌন সম্ভোগের বস্তু, মা নয়-বোন নয়, কেবলই যৌনতা তাদের মনে।
আরেকটা বিষয় ভাবতেই অবাক লাগছে যে, চিত্রনায়িকা নাজনীন আক্তার হ্যাপির ঘটনায় শোবিজের নারীরা আশ্চর্যরকম চুপ মেরে আছে, চুপ মেরে আছে আমাদের তথাকথিত নারীবাদী নেত্রীরাও। যেন হ্যাপি হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে মহা বেয়াদবি করে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, এসব ঘটনা তাদের অজানা, কোনদিন তারা ফেস করেনি এসবের। কিন্তু কাজের কল্যাণে অনেকের ব্যক্তিগত জীবন যে আমাদের জানা, সেটা তারা ভুলে যায়। নারীনেত্রীরাও সেই কেলেংকারি থেকে মুক্ত নয়।
হতে পারে, হ্যাপি অন্য যেকোনো মেয়ের মতোই ওপরে উঠার সিঁড়ি ধরতে গিয়ে দশজনের সাথে বিছানায়ও যেতে পারে (সবই হতে পারে বলছি), কিন্তু সে যদি রুবেলকে ভালবেসে তার সাথে একবারের জন্যও শারীরিক সম্পর্ক করে থাকে, যেখানে ভালবাসার প্রতিশ্রুতি ছিল, ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, এবং সেইক্ষেত্রে রুবেল তা অস্বীকার করলে তা প্রতারণার পর্যায়েই পড়ে। হ্যাপি মুখ ফিরিয়ে নিলে তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হতো। যেমনটি হয়েছিল প্রভার ক্ষেত্রে। প্রভার বিয়েটা পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। ওর তখনকার স্বামী নামক পুরুষটির পৌরুষে কুলোয়নি প্রভাকে গ্রহণ করে নিতে।
গণমাধ্যমে এই সেদিনই একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে গ্রেপ্তার করা হলো পর্নোগ্রাফি আইনে। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি, তারা কি এই সালামের লুচ্চামির কথা জানি না? জানি না, কতগুলো মেয়ে সালামের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে? আর কতগুলো মেয়ে জাস্ট বলি হয়েছে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার? জানি, কিন্তু মুখ খুলি না। গণমাধ্যমে সালাম কিন্তু একজনই নন, কয়েকশ সালামের নাম এক লহমায় বলে দেয়া সম্ভব। বলবো?
আবারও বলছি, হ্যাপির বিষয়ে মুখ খুলতে গিয়ে কিছুটা সংযত হোন, তাকে এতোটা নিচে না নামালেও চলবে। তাতে আপনাদের উচ্চতা মোটেও বাড়ছে না, এটা মনে রাখবেন। আজ একজন হ্যাপি মুখ খুলেছে, তাতেই আপনাদের রক্তচাপ, রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গেল, ভাবুন তো, যদি ঘরে ঘরে হ্যাপিরা মুখ খোলে, তাহলে আপনাদের কী হবে?
বিচারে যাই প্রমাণ হোক না কেন, রুবেল একবার কেন, শতবার বেরিয়ে এলেও আমি হ্যাপির পক্ষেই থাকবো। এই সমাজ মেয়েদের ‘বেশ্যা’ বলতে দ্বিধা করে না, বিশেষ করে পান থেকে চুন খসলে মেয়েটারই দোষ হয়, কিন্তু আমার চোখে দেখা হাজার হাজার পুরুষ যে ‘বেশ্যা’ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বিচার করবে কে? আছে কি আরও কোন হ্যাপি, যে সাহস নিয়ে বলতে পারবে গণমাধ্যমের সেইসব ‘বড় ভাই’দের ‘সুকীর্তি’র কথা?