সোভিয়েত নারীর দেশে-২৪

ami 3সুপ্রীতি ধর: সেই কবে লন্ডন যাত্রার কথা লিখেছিলাম, মাঝে অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। কিছুতেই লিখতে পারছিলাম না। আসলে সোভিয়েত জীবন নিয়ে লেখাটা যত সহজ ভেবেছিলাম, ততটা সহজ আসলে নয়।

জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালী সময়টা কাটিয়ে এসে বিক্ষুব্ধ জীবনের ঢেউয়ে ভেসে যেতে যেতে কতুটুকই বা সময় মেলে নিজের জন্যে? সেই জীবন আর এই জীবনে যে আকাশ-পাতাল তফাত। যেমন তফাত সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে, তেমনি বয়সের তারতম্যেও। তখন দুচোখে সবকিছুই সৌন্দর্য ঠেকতো, কিন্তু বাস্তবে জীবনটা যাপন করতে গিয়ে কোন কূল-কিনারাই করা হয়ে উঠে না। তাই সুখস্মৃতিগুলো হাতড়াতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বৈতো কিছুই আসে না।

 কলচেস্টারে কাজ পেয়েছিলাম ‘থারা’স রেস্টুরেন্ট’ এ। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, ‘তারা’র রেস্টুরেন্ট’। ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী থারা জ্যামাইকান হয়ে যাওয়ায় তারা হয়ে গেছে থারা। তবে ঊনি খুবই মারকুটে ছিলেন।  সালোয়ার-কামিজ পরা দেখে প্রথমদিনেই আমাকে তার মনে ধরেছিল। ওয়েটার হিসেবে আমি ছাড়াও একজন ছিলেন চাইনিজ মেয়ে, অপরজন ব্রিটিশ-ভারতীয়। রান্নাঘরেও এমনই মাল্টিন্যাশনালের ছড়াছড়ি। শেফ ছিলেন খোদ সিলেটি, তন্দুরি শেফ তিউনিসিয়, পাকোরা বানাতেন একজন চাইনিজ আর সহকারি ছিল রাশিয়ায় পড়া আরেক বাংলাদেশি।

শেফ ভাই (এতো বছর পর নামটা আর মনে নেই) প্রথমদিনেই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার সিলেটি বাংলায়, বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে এসেছি আমি। যখন বলেছি ময়মনসিংহ, তিনি কিছুক্ষণ ভেবে আবারও প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটাকি বাংলাদেশের মধ্যে পড়েছে, নাকি ভারতে?’

আমি পুরাই থ হয়ে গিয়েছিলাম তার নিজের দেশ সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি দেখে। তবে মনটা অসম্ভব ভাল ছিল শেফ ভাইয়ের। রাশিয়ায় পড়ালেখা করি শুনে তিনি কথাপ্রসঙ্গে জানতে চাইতেন, ওখানে আমরা কি খাই, না খাই। শীতের দেশ, তার ওপর গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রোইকার প্রভাবে ততদিনে আমরা অভাবগ্রস্ত, খাবার-দাবারের সংকটের কথা শুনে ঊনার খুব কষ্ট হতো বুঝতাম। সুযোগ পেলেই এটা-সেটা রান্না করে লুকিয়ে-লুকিয়ে খাওয়াতেন আমাদের। কত রান্না যে জানতেন, তার ইয়ত্তা নেই।

কিন্তু চোরের দশদিন আর গৃহস্থের একদিন বলে একটা কথা আছে না! একদিন এরকমই খাওয়ার সময় ঠিক মিজ থারা এসে উপস্থিত। আমাদের পাতে বড় গলদা চিংড়ি দেখেই উনার মস্তক পর্যন্ত ঘুরে গেল। নিজেকে না সামলেই তিনি শেফ ভাইয়ের ওপর চড়াও হলেন। কেন তিনি এসব খাবার আমাদের দিচ্ছেন, এক কথা, দুই কথায় কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। আমরা না পারছিলাম খেতে, আবার ফেলতেও চাইছিল না মন, এতো বড় বড় চিংড়ি, রাশিয়াতে তো পাই না। শেফ ভাই এক পর্যায়ে রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন রেস্টুরেন্ট ছেড়ে। আমাদের বাইরে ডেকে বলে গেলেন, দুদিন আসবেন না, তাকে ডাকলেই তিনি আবার আসবেন। আমরা দুই ছাত্র প্রমাদ গুনলাম, ভাবলাম, গেল রে চাকরিটা। যাও কয়টা টাকা আসছিল সপ্তাহশেষে, তাও বুঝি গেল।

পরদিন সকাল ১১টায় রেস্টুরেন্টে এসে শুনি ওইদিন বন্ধ থাকবে। শেফ নেই, চলবে কি করে!  একদিন যায়, দুদিন যায়, আমরা ফিরে ফিরে আসি। গল্প করি, ঝাড়মোছ করি। আমার কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে, সপ্তাহ শেষে বেতন ঠিকই পাবো, কিন্তু প্রতিদিন যে টিপস পাচ্ছিলাম, সেটা তো মিস্ করলাম। দেখতে ছোটখাটো  ছিলাম বলে অনেক ব্রিটিশই  আমাকে দয়া করতেন, খাওয়ার পর টিপসটা কার্ডে না দিয়ে আমার হাতে গুঁজে দিতেন। সেটা একান্তই আমার ছিল। তাছাড়া মিজ থারা, এমন মেজাজি আর খামখেয়ালি যে, পুরো এক মাসের মধ্যে তিনি দুই কি তিনদিন মাত্র সবাইকে ডেকে টিপসের টাকা ভাগ করে দিয়েছিলেন। কার্ডে যে পেমেন্ট হতো, সেই টিপসের ভাগ আমাদের কপালে জুটতো না।

এরকম টিপস এর আয়ও কিন্তু কম ছিল না। সপ্তাহ শেষে আমি বেতন পেতাম ৭০ পাউন্ড, আর টিপস মিলিয়ে হতো ১১৫ পাউন্ড। মন্দ না। সেইন্সবারিতে বাজার করে হোস্টেলে রান্না করতাম বলে ১০ পাউন্ড দিয়ে অনেকদিন চলতো।  বাইরে কমই খেতাম, অনেক দাম সেই খাবারের। গাড়িভাড়াও ছিল অনেক। কিন্তু  সকাল ৯টার পর গেলে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট কার্ড দিয়ে টিকেট কাটতাম প্রায় ছয় গুণ কম দামে।  লন্ডনে সারাদিনের জন্য একটা ট্রাভেল কার্ড কিনে নিয়ে যত লাল বাস আছে, সবগুলোতেই চড়তে পারতাম।

হোটেলে কাজের টাকা দিয়ে আমরা তখন লন্ডন এসে ঘুরে বেড়াতাম এভাবেই। যত মিউজিয়াম আছে, সব  দেখার নেশায় পেয়েছিল তখন আমাকে। বাড়তি কোনো কেনাকাটা নেই, কেবলই মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে ঘোরাঘুরি। আরেকটা ঘটনা ঘটাতাম আমি। সকালে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পারফিউমের শপ হয়ে যেতাম রেস্টুরেন্টে। যত পারফিউম সামনে রাখা হতো টেস্ট করার জন্য, সবগুলো টেস্ট করা চাই। ফলে দিনভর পারফিউমের গন্ধে ভরপুর থাকতাম আমি, কিন্তু পয়সাও লাগতো না। কোনদিক দিয়ে দিন শেষ হয়ে এলো, এবার ফেরার পালা।

এবার আর ভুল করিনি। যাওয়ার সময় হারউইচ থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে এবার আর সিট কিনিনি।  শিপে উঠেই একটা সোফা দখল করে নিলাম। দেখলাম, কেউ আমাদের উঠিয়ে দিল না। আরামেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলে এলাম। বিপদ হয়েছিল আমাদের হাতের বোঝা। লেনিনগ্রাদে পড়াশোনা করা আমাদের এক বড় ভাই শাহীন ভাই তার রুশ স্ত্রীর জন্য এক ঢাউস সাইজের ব্যাগভর্তি শ্যাম্পু-জুতা, হাবিজাবি কিনে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা  ইউকে’তে বসেই সেই ব্যাগের অর্ধেক জিনিস রেখে এসেছিলাম। হাতে করে টেনে আনা প্রায় অসম্ভব ছিল। মাথায়ও ঢুকছিল না, কেউ উড়নচন্ডি টাইপের দুজনের হাতে এমন ব্যাগ কী করে ধরিয়ে দেয়!

ফিরতি যাত্রায় পশ্চিম জার্মানি ঘুরে রাতের বেলা কাঠের ঘরের ইমিগ্রেশন পার হয়ে চলে আসি পূর্ব জার্মানিতে। রাতটা পশ্চিমের দেশে নিরাপদ মনে হচ্ছিল না আমাদের। পূর্বই ভাল তখন পর্যন্ত। রেল স্টেশনে  জিপসিদের চুরির ভয়ে মাথার নিচে জুতা দিয়ে পত্রিকা বিছিয়ে গা এলিয়ে দিলাম আমরা কজনা। মূহূর্তেই ঘুম। সকালে ধুম ধুম শব্দে ধরফড়িয়ে জেগে দেখি, জার্মান পুলিশ জিপসিদের পিটিয়ে বের করছে স্টেশন থেকে। আর শুয়ে বা বসে থাকা নিরাপদ ভাবলাম না। হাজার হোক, জিপসিদের সাথে আমাদের চেহারাতে অনেক মিল। কে জানে, কখন পুলিশের বাড়ি এসে পড়ে পিঠের পর।

Peter 6সেদেশের এক টাকা দিয়ে বাথরুম+স্নান সেরে বের হয়ে এলাম স্টেশন থেকে। সামার চলছে। কাজেই  টি-শার্ট আর প্যান্টেই চলে যাচ্ছে। যদিও হালকা একটা সোয়েটার জাতীয় কোমরে বাঁধাই থাকে। পাউরুটি-কলা কিনে সকালের ব্রেকফাস্ট সারলাম পার্কে বসে। ভাষা তো বুঝি না, তাই স্টেশনটাকে  লক্ষ্য হিসেবে রেখে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। এখানে ঘুরি-সেখানে ঘুরি। মিউজিয়াম দেখলাম। উইন্ডো শপিংও বাদ গেল না।

লন্ডনে যা কামিয়েছিলাম, সব তো  খুইয়ে এসেছি মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে। কাজেই কেনার সামর্থ্য নেই। কেবলমাত্র শরীরটাকে এখন টেনটুনে নিয়ে লেনিনগ্রাদে ফেললেই হবে। সেখানেই সব শান্তি। দুপুরে লাইনে দাঁড়িয়ে এক বোল বাঁধাকপি-সসেজের স্যুপ নিলাম, অমৃত মনে হলো মুখে। বিষাদ লাগলো কেবল পানিতে। পানি খেতে গেলেই বিয়ারের গন্ধ পাই। ভয়ে জুসও খাইনি। শুধুমাত্র রাতের বেলা ট্রেনে উঠে পানি খেতে পেরেছিলাম।

ট্রেনে উঠেই একটা হাঁফ ছাড়লাম। উঠেই প্রথম যে কাজটি করলাম, ট্রেনের ওয়াগনের দায়িত্বে যে বাবুশকা (বয়স্কা নারীদের আমরা বাবুশকা বলে ডাকতাম, বাবুশকা মানে নানী-দাদী) ছিলেন, তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বেশ অনেকদিন পর রুশ ভাষায় কথা বলতে পারলাম প্রাণখুলে। আর উনিও সেই আনন্দে চা খাওয়ালেন আমাদের। যাক্ শেষপর্যন্ত ঘরে ফেরা হচ্ছে। ঘরে ফেরাই কিন্তু।

তখন সোভিয়েত ইউনিয়নটা ছিল আমাদের আরেকটা দেশ, আরেকটা নতুন জন্মভূমির মতো।  যেখানেই যেতাম না কেন, ঘরে ফেরার তাগাদা থাকতো, এমনভাবে কোন দেশ কাউকে কোনদিন আঁকড়ে ধরতে পেরেছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু পরবর্তীতে উদয়ন বা প্রগতি প্রকাশনির লেখা পড়া মানুষজনকেও এই দেশটিকে আপন ভাবতে দেখেছি, এখনও তারা ভাবেন, আমি নিশ্চিত। এবং কিছুটা ঈর্ষার চোখেই দেখেন আমাদের, যারা আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান তারুণ্য রেখে এসেছি ওই দেশটাতে।

যখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন কথাটা লিখি, বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠে কী এক সুতীব্র বেদনায়, যাতনায়, এ বোঝানো দায়! জানি না, এ বিষয়ে আমি মোটেও বোদ্ধা নই, হয়তো সমাজতন্ত্রের সুগভীর যে চেতনা, এটা তাই। আমরা তা ধারণ করে আছি। (চলবে)

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.