উইমেন চ্যাপ্টার: চিত্রনায়িকা নাজনীন আক্তার হ্যাপি আর জাতীয় ক্রিকেট দলের পেসার রুবেল হোসেনের কাহিনী এখন সবার মুখে মুখে। আমরা পাঠকরা যতবেশি এ নিয়ে উচ্ছসিত বা ঘর্মাক্ত হয়ে পড়ছি ওদের কথা বলতে গিয়ে, এমনকি বন্ধুতে-বন্ধুতে বিবাদেও জড়িয়ে পড়ছি, ওরা দুজন নিশ্চয়ই অতটা করছেন না। বা করলেও আমরা সেই খবর জানতে পারছি না। বিষয় যখন নারীতে গড়ায়, সেখানে ‘সেক্স’ প্রসঙ্গ না থাকলেও অদৃশ্যভাবে তা উঠে আসেই আলোচনায়। আর এটা তো প্রকাশ্য ‘সেক্স’ কাহিনী।
নাজনীন আক্তার হ্যাপি জাতীয় দলের এই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। হ্যাপিকে এজন্য স্যালুট জানাতেই হয়। কারণ এই সমাজের তথাকথিত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বন্ধ দরজার ভিতরের বিষয়টি বাইরে আনার মতো মানসিক সক্ষমতা আছে তার।
কিন্তু এই ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে। একচেটিয়াভাবে হ্যাপির বিরুদ্ধে কটূক্তি করতেও পিছপা হন না অধিকাংশই। এসবকেই রুবেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে আরেক পক্ষ। এদিকে রুবেল নিজেও হ্যাপির সাথে সম্পর্কের গভীরতাকে অস্বীকার করে আসছেন প্রথম থেকেই। ফেসবুকে যাদের আমরা অনেক কারণেই শ্রদ্ধা করি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা ছাড়াও কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে লেখেন, সেই তারাও দেখি হ্যাপি কাহিনীতে রগরগে গল্প বলতে দ্বিধা করেন না। তখন অবশ্যই হোঁচট খাই।
অনলাইনে কিছু সীমিত বন্ধুমহলে প্রশ্নটা ছেড়েছিলাম, আপনারা এ নিয়ে কে, কি ভাবছেন? হ্যাপি যা করেছেন, তাকেই বা কিভাবে দেখছেন? এটা কি ওর একটা সাহসী পদক্ষেপ? নাকি অন্যদের মতোন সস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার উপায় হিসেবে ভাবছেন? ঘরে ঘরে যখন মেয়েরা এরকম প্রতারণার শিকার হচ্ছে অহরহ, তখন হ্যাপির এই ঘটনা কি সামান্য হলেও প্রতিবাদ নয়?
তাছাড়া হ্যাপি-রুবেলের এই ঘটনা সমগ্র লুচ্চা প্রজাতির পুরুষদের জন্য সতর্কবার্তা নয় কী? একইসাথে মেয়েদের প্রতিবাদী হওয়ারও পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। কি ভাবছেন আপনারা? মতামতগুলো নিচে দেয়া হলো:
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: রুবেল হ্যাপীর রিলেশনটা বিয়ে অব্দি গড়ালে কেউ এই এটা নিয়ে কোন কথা বলতে আসত না। কিন্তু যখন এতদূর গড়ানোর পর একজন বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন সেটা সত্যি বেদনাদায়ক হয়! হ্যাপির উচিত হয়নি রুবেলকে বিশ্বাস করা। এতবেশি না জড়ানোই উচিত ছিল। তারপরে যা ঘটছে প্রায় সবাই হ্যাপীকে নিয়ে চরম বাড়াবাড়ি করছে। অনেক নারীও অবিবেচকের মতো অরুচিকর মন্তব্য করতে দ্বিধা করছে না। রুবেলকে হিরো বানানোর যে চেষ্টা চলছে মিডিয়ায় তাতে এমন ঘটনায় উৎসাহিত হবে অনেকে। হ্যাপি শেষে যা করেছে এটা একটা দৃষ্টান্ত। অনেক মেয়ে যা পারে না, সে তাই করেছে। রুবেল ভাল খোলোয়ার, কিন্তু তাই বলে তার যা খুশি তা করার অধিকার নেই। তাদের অারো সংযত হওয়া অনেক জরুরী।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: আমার একটা বিষয় কি মনে হয়, নারী-পুরুষের বাইরে গিয়েও…তা হলো, ওভারঅল আমাদের নৈতিকতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। কী নারী, কী পুরুষ! একটা ছেলে বা মেয়ে পাঁচজনের সাথে শুয়েও সৎ থাকতে পারে, আবার কারো সাথে না শুয়েও অসৎ হতে পারে। কিন্তু রুবেল, সে তো একটা পাবলিক ফিগারও, তার একটা মিনিমাম নৈতিকতার মান থাকবে না?
হ্যাপি-রুবেলের ফোনালাপ শুনে মনে হয়েছে, সেক্স ছাড়া রুবেলের আর কিছু চাইবার ছিল না আর হ্যাপি চেয়েছিল, দাঁড়া আগে তোকে বিয়েটা করে বেঁধে নিই, এভাবে যে বাঁধা যায় না, তাই তো এই মেয়েটা জানে না। তবে তার মামলা করার প্রথম প্রক্রিয়াটিকে আমি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবেই দেখি।
হ্যাপিকে বলা হচ্ছে, প্রায় প্রস্টিটিউট, উঠতি নায়িকা তাই কৃতি ক্রিকেটার ধরে বেড়াচ্ছে, আর রুবেল এর ক্ষেত্রে ভাবটা এমন, আহারে বেচারা না হয় করেছেই একটু-আধটু, খেলে তো ভালো…এই জায়গাটিতেই ভয়েস রেইজ করা উচিত। মেয়েদের সস্তা, উঠতি বলে যারা ঠোঁটের কোণে হাসে, রুবেলকেও তাদের চরিত্রহীন, মেয়ে পটানো হিসেবে দেখে বিচার করতে হবে…।
ফারহানা আনন্দময়ী: হ্যাপি-রুবেলের ফোনালাপ আমি শুনিনি। মানে শুনবার আগ্রহ হয়নি। তবে একজন নারী যখন কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়, বিশেষ ক’রে কোনো সেলেব টাইপ মানুষের সঙ্গে, তখন নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়েই জড়ানো উচিত। আমি কতটুকু তাকে ধারণ করতে পারবো, কতটুকু বিশ্বাস করতে পারবো, কতটুকু গিয়ে সীমা টানবো… সেটা সম্পর্কে নিজের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। আর দুইজন পরিণত বয়স্ক নারী-পুরুষ যখন স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে ( যতদূর পড়েছি হ্যাপি নিজের ইচ্ছায় একাধিকবার রুবেলের ফ্ল্যাটে গেছে, তাকে কেউ জোর ক’রে নিয়ে যায়নি)। তখন পরে একপক্ষ যদি প্রতারণা করে, তা নিজ দায়িত্বে নিজের সম্মান রেখেই মোকাবেলা করা দরকার। অপরপক্ষকে একতরফা দোষারোপ ক’রে নয়। এটা প্রতারণার মামলা হতে পারে, ধর্ষণের মামলা নয়।
তানিয়া কামরুন নাহার: অবশ্যই ‘লুইস’ প্রজাতির পুরুষদের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। তবে হ্যাপির মতো মেয়েরাও যেন গাধামি না করে, সেদিন থেকে এটি একটা শিক্ষাও বটে!
মাহমুদা শেলী: মেয়েদের প্রতি আমার সাজেশন হলো, যে মেয়েরা দীর্ঘকাল একটি ছেলের সাথে যখন সম্পর্কে যাবে, তখন যেন বিয়ে অব্দি না গড়ায় । যৌনতা খুবই বেসিক মানছি, কিন্তু তাই বলে ছেলের কাছ থেকে বিয়ের স্বীকারোক্তি নিয়ে যৌনতায় যাওয়া কেন ?? যৌনতা তো কেবল ছেলেদের জন্য বৈধ নয়, মেয়েদের জন্যেও। আর হ্যাঁ, মেডিকেল রিপোর্টে পজিটিভ রিপোর্ট যদি নাও আসে, সেক্ষেত্রেও হ্যাপি রুবেলের অন্তরঙ্গ মূহূর্তের ছবিই য়থেষ্ট আমার মতে !!
সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: ইমরান খান বিয়ে করেছে ৬২ বছর বয়সে, এটা তার কততম বিয়ে, কোন ব্যাপার না কারো কাছে। যাকে বিয়ে করেছে সেই বিবিসির উপস্থাপিকা রিহাম কবে কি পোশাকে কার কার সাথে নেচেছে সেটাই আমার দেশের অনলাইনগুলোর নিউজ। হ্যাপির বিষয়টাও তাই! রুবেল হ্যাপির সাথে চিট করেছে এটা ব্যাপার না কারো কাছে। হ্যাপি বিচার চেয়েছে ও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে রুবেলের সম্পৃক্ততার কথা, তাই হ্যাপিকে নিয়ে যত বাড়াবাড়ি মিডিয়ার! আমাদের সমাজ ব্যাবস্থাও এতো জঘন্য যে এখানে একজন স্ত্রী আত্মহত্যা করলে মরে যাওয়া স্ত্রীর দোষ খোঁজে মানুষ। আবার সেই স্ত্রীর স্বামীটি আত্মহত্যা করলেও সেই স্ত্রীরই দোষ হয়!
আয়েশা আক্তার কণা: বিষয়টা ছেলে বা মেয়ে এমনভাবে দেখার কিছু নেই বোধহয়। পুরো ঘটনাটাই জঘন্য এবং দুজনেই কুৎসিত। দুই এডাল্ট প্রেমে পড়েছিল, এটা সুন্দর। তাদের সম্মতিতেই শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছে। আজ পথ ভিন্ন তো আয় দেখে নেই তোকে। এটা কুৎসিত।
আর আমরা? করতে শিখেছি, “পক্ষাপক্ষি”… ঘটনার শেষ বা সবটুকু না জেনেই, এর- ওর মুখের কিছু কথা শুনেই মোটামুটি ঝাপিয়ে কনক্লুুশনে গিয়ে এই পক্ষ আর ওই পক্ষ করে থাকি.. পারিও বটে আমরা।
ঝর্ণা রায়: আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা দিদি। মেয়েটারই বা আজ সবার সামনে এমন সম্মান হানিকর ঘটনার বর্ণনা করতে হবে কেন? আর হতে যাওয়া সেলিব্রেটি খেলোয়ারকেও বা মাঠ রেখে কোর্ট-কাচারি যেতে হবে কেন? মনে হয় নিজেদের কাছেই নিজেদের সম্মানের দাম নেই।
নাহিদ সুলতানা: এইসব সম্মান-টম্মান করতে করতেই আমরা রুবেলদের ধরতে পারি না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
কামাল এইচ মজুমদার মুন: কিছু কিছু বিষয় মারাত্বক লক্ষ্যণীয়, মানবীয় প্রেম আর সামাজিক আইনী বিয়ের বিষয়টি৷ নারীর অধিকার ও আমাদের সমাজের যে পিছিয়ে থাকা চিন্তাধারা, তা এই ঘটনায় উঠে এসেছে। সমস্যা হলো, (metaphysical) মেটা-ফিজিক্যাল ও ফিজিক্যাল একটি বিষয়কে কোন নিক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ ও সিদ্ধ করা যায়, তাও সেটা যদি হয় তৃতীয় বিশ্বের একটি সমাজে৷ হেয় করছি না আমাদের সমাজকে, কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সত্যি দুষ্কর ৷
মাহমুদা শেলী: আমি তো পাজেলড হয়ে আছি হ্যাপির মামলার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জনগণের এটিচ্যুড দেখে। মগের মুল্লুকে বাস করছি আমরা! কত ভয়ংকরভাবে জনগণ রুবেলকে সার্পোট করছে। খোদ ক্রিকেট বোর্ড এখন পর্যন্ত রুবেলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ফৌজদারী মামলার অপরাধীকে প্রমাণের আগেই প্রতিষ্ঠান থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিধান রয়েছে, যা জাতীয় ক্রিকেট বোর্ড করেনি। দ্বিতীয়ত, এই মামলার অপরাধীর বিরুদ্ধে FIR হলেই তাকে গ্রেফতার করা এবং যতদিন মামলা আদালতে নিষ্পত্তি না হবে, ততদিন অপরাধী জেল হাজতেই থাকবে..! অন্ততঃ তিন মাসের মধ্যে জামিন পাবার অধিকার নেই । তৃতীয়ত, রুবেলের ক্ষেত্রে খোদ বিচার বিভাগ আইনটি ভায়োলেট করেছে তাকে প্রথম অভিযুক্ত করার পর আদালত রুবেলকে আটকের নির্দেশ না দিয়ে।
ফারহানা হাফিজ: একটা আওয়াজ তোলার চেষ্টা চলছে যে মামলায় রুবেল নির্দোষ প্রমাণ হলে ক্লিয়ার হয়ে যাবে হ্যাপি রুবেলকে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। আমার ইস্যুটা হলো হ্যাপি বা হ্যাপির মতো এ ধরনের প্রতারণার শিকার মেয়েরা যখন বুঝতে পারে যে, রিলেশনশিপ বা ভালবাসাটাই মিথ্যা ছিল, সেই মানসিক অপমানকে কিভাবে আইন দিয়ে প্রমাণ করবে? তার তো কোন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক বা তা অ্যাপ্লাই করার মতো মানসিক গড়ন সমাজের হয়নি। দ্বিতীয়ত, হ্যাপি যদি সমাজের বানানো কলগার্লও হয়, এবং এ ধরনের মিথ্যা ভালবাসার শিকার হয়, তারও তো আইনী লড়াই চাইবার অধিকার আছে। এই দেশে খুনি, সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ারে মরলে মানবিকতা দেখানো যায়, তাহলে লড়াই করা মেয়েদের জন্য নয় কেন?