শান্তা মারিয়া: গরীবের ঘোড়ারোগ নামে একটি কথা বহুযুগ থেকেই বাংলায় প্রচলিত আছে তারই প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৫ সালের প্রথম মুহূর্তে। ঢাকার আকাশে থার্টিফার্স্ট নাইটে আতশবাজির জেল্লা দেখে থমকে গেলাম। প্রায় প্রতিটি পাড়া, মহল্লায় এই ফায়ারওয়ার্কস দেখা গেছে। কর্ণপটাহ বিদারী পিলে চমকানো আওয়াজ এবং হঠাত্ আলোর খেলা দেখে চমকে উঠেছিলাম।
মনে হয়েছিল হরতালের বোমা নাকি? পরে বুঝলাম, না, ধনী ঢাকাবাসী পাশ্চাত্য কায়দায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে।
মনে পড়ল নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার মানুষ যখন বিপর্যস্ত, চাষীরা সর্বস্বান্ত, দলে দলে ভুখা মানুষ যখন ছুটছে নগর কলকাতার দিকে একটু অন্নের প্রত্যাশায়, সে সময়ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী জমিদারবাবুরা ইংরেজ প্রভুদের খুশি করতে পুতুলের বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর বাজি পোড়াতেন।
যে ঢাকা শহরের ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে এখনও অসংখ্য হতদরিদ্র শিশু, নারী ও প্রবীণের দেখা মেলে, যেদেশে শীতবস্ত্রের অভাবে আজও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মৃত্যু হয়, সেখানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে বাজি পুড়ানো উপযুক্ত কাজই বটে। ইতিহাসে পড়েছিলাম, রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো তখন নাকি বাশিঁ বাজাচ্ছিলেন মনের আনন্দে। হরতালে নষ্ট রাজনীতির আগুনে যখন ধ্বংস হচ্ছে মানুষের জীবন, শীতে যখন কাঁপছে দরিদ্র মানুষ, তখন ফায়ারওয়ার্কসের খেলা দেখে কতটা আনন্দ ধনিক শ্রেণি পেল তা জানতে বড়ই ইচ্ছা করছে।

শুধু অর্থের অপচয় নয়, পরিবেশের ক্ষতির কথাও তো মনে রাখা প্রয়োজন ছিল। বেইজিংয়ে একসময় দেখেছি চীনের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষে বাজি পুড়িয়ে অশুভ শক্তিকে তাড়ানোর প্রথা বেশ জোরেশোরে উদযাপন করতে। কিন্তু চীন সরকার এই প্রথা রোধে বর্তমানে খুবই সক্রিয়। বিশেষ করে কয়েকটি নগর-সরকার এই প্রথা একেবারে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।তারা বলেছে অশুভশক্তিকে তাড়ানোর জন্য যদি শব্দ করা একান্তই প্রয়োজন বলে নগরবাসীর মনে হয়, তাহলে কোটি কোটি টাকার বাজি না পুড়িয়ে বিনা খরচে লাউড স্পিকারে শব্দ করার একটি যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
বাজি পুড়ানোর ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হয় তার বিরুদ্ধে এখন বিশ্বজুড়েই জনমত গড়ে উঠছে। বাজি পোড়ানোর কারণে যে বারুদ ও অন্যান্য কেমিকেল পোড়ে তা ওজন স্তরের ব্যাপক ক্ষতি করে। এবং বায়ুমণ্ডলের এই ক্ষতি শুধু একটি এলাকা বা একটি দেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। বিশ্ব পরিবেশের উপরেই এর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। সুন্দরবনে তেলের ট্যাংকার ডোবার জের যেমন আমাদের এবং বিশ্বপরিবেশকে টানতে হবে বহুকাল, তেমনি এই আতশবাজির রঙিন নেশার মাশুলও বিশ্ব পরিবেশকে গুনতে হবে।
চীনারা তাদের ঐতিহ্যের ক্ষতিকর আচার অনুষ্ঠানগুলো ত্যাগ করতে যাচ্ছে, আর পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে যা আমাদের ঐতিহ্য নয়, তা আমরা আমদানি করছি। নির্বোধ ধনী আর কাকে বলে। ছোটবেলায় স্কুলে ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো, ‘মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে’। আমাদের ধনী ব্যক্তিদের আমোদফূর্তি করতে ইচ্ছে হয়েছে, বেশ তো, তারা দরিদ্র শীতকাতর জনগোষ্ঠির মধ্যে গরম কাপড় বিতরণ করেও তো নিজেদের শানশওকত প্রদর্শন করতে পারতেন, কিংবা দরিদ্রমানুষকে একবেলা সুখাদ্য খাইয়ে নিজের অর্থবল দেখাতেন, তা না করে একি উৎকট আমোদ। অবৈধ পথে যারা বিপুল অর্থ উপার্জন করে তারাই বিকৃত পথে তা ব্যয় করতে বেশি উত্সাহী হয় একথা সবাই জানে। হৃদরোগী, শিশু, বৃদ্ধ,পরীক্ষার্থী এবং দরিদ্র মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা না করে যারা নববর্ষের রাতে উদ্ভট আমোদে মাতলেন তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে। এখনো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও শিক্ষা সকলের জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। এখনো হাসপাতালের করিডোরে বিনা চিকিৎসায় মানুষের মৃত্যু হয়। এখনো লেখাপড়া ছেড়ে পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনে নামতে হয় শিশুদের। সে দেশে মুষ্ঠিমেয় ধনীর বাজি পুড়িয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অনুকরণে নতুন বছরের উত্সব পালন, যেন ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম।
নববর্ষের রাতে যে কত টাকার ক্ষতি হলো তার হিসাব অর্থনীতিবিদরা করে দেখতে পারেন। আমার মতো সাধারণ মানুষের তরফ থেকে এসব নির্বোধের জন্য ঘৃণা প্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।