রওশন আরা বেগম: আমার বান্ধবী রিতা, তবে একই ভাষাভাষির নয়। জাতীয়তায় পাকিস্তানী। টরন্টোতে সে আমার প্রতিবেশী। ছোট-খাটো আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে যেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ঠিক সেইভাবেই পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, যা আজও অটুট। সে ছিল প্রচণ্ড হাসি-খুশী একটি মেয়ে।
দুজনের একই বয়স হওয়ায় বিকালে পার্কের আড্ডাটা বেশ জমতো। তার তিন বছরের ছেলেটির সঙ্গে আমার মেয়েটিও একই সঙ্গে খেলাধুলা করতো। পাকিস্তানে সে ভ্যাট বা প্রাণীর ডাক্তার হিসাবে চার-পাঁচ বছর চাকুরিও করেছে। স্বামী ব্যাংকার। সব ছেড়ে কানাডায় এসেছে।
সঙ্গে তার একটি ভাইও ছিল। ছোটকাল থেকেই ভাইটি তার প্রচণ্ড মেধাবী। কানাডায় এসেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বেশ ভাল বেতনের চাকুরিও করছিল। হঠাত একদিন রিতা আমাকে জানাল যে, তার ভাইটির চাকুরি চলে গেছে। কি কারণে হয়েছে তা কাউকে বলে না। সারাদিন ঘুমিয়ে দিন কাটায়। আর রাতে তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে।
এইভাবে বেশ সমস্যার মধ্যে তাদের দিন কাটতে থাকে। একদিন খুব সকালে রিতা আমার বাসায় এসে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জানাল, তার ভাই গতরাতে তার স্বামীর সাথে মারামারি করেছে। বাধ্য হয়েই সে পুলিশ কল দিয়েছে। সে ছাড়া তার ভাইয়ের আর কেউ নেই এই কানাডাতে। পুলিশ ডেকে সে যেন বড়ই অন্যায় করে ফেলেছে। আমি তাকে বুঝালাম তার কিছুই হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর একদিন সে আমকে জানাল- তার ভাই আলাদা বাসা নিয়েছে। মাঝে মাঝে সে রান্না করে নিয়ে যায়। ভাইয়ের জন্য তার মায়ার শেষ নেই। সে প্রায়ই আমাকে বলতো আমারতো স্বামী বাচ্চা আছে, আমার ভাইতো বড়ই একা। আমি ছাড়া তার কেউ নেই। তাই প্রায়ই সে তার ফ্লাটে গিয়ে রান্না-বান্না, ক্লিনিং সব করে দিত। এই ভাবে সে তার ভাইটির দেখাশোনা করতো।
এইভাবে বেশ কিছুদিন ভাল ভাবেই চলছিল। হঠাৎ রিতার মধ্যে আমি বেশ পরিবর্তন দেখি। সেই হাসি আর নেই। পার্কের আড্ডায় তাকে আর দেখা যায় না। সারা দিন বাসায়, কোথাও তেমন বের হয় না। কি এক নিষিদ্ধ পাপ পাথর চাপা দিয়ে বুকের ভিতরে রেখে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করছে। আমাকে সে জানায় তার ভাই তাকে নির্যাতন করেছে। সেই নির্যাতনের ধরন, প্রকৃতি কিছু না বলেই চোখের জলে বুক ভাসায়। সুতরাং আমাকে ধরে নিতে হয় সেই নির্যাতন হয়তো মারধর অথবা অপমান সূচক শব্দাঘাতের মত কিছু।
সান্ত্বনা দিলাম, তবে তাতে বিশেষ কোন কাজ হল না বলিই মনে হল। স্বামীর অবর্তমানে তার ভাই তার উপর যে নির্যাতন চালাতো তার স্বরুপ আমি তখনও ধরতে পারি নাই। হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যার মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ল রিতার নির্যাতনের প্রকৃতি ও ধরন।
একদিন তার বাসায় বেড়াতে গিয়ে পড়লাম মহা দুর্যোগে। তার ভাইকে দেখি সোফায় বসে আছে।
হাতের কাছে পেয়ে আমি তাকে নানা উপদেশ দিতে থাকি। রিতা আমাকে সতর্ক করে দিল কথা না বলার জন্য। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। রীতা চিৎকার করে বলতে থাকে- ও জন্তু হয়ে গেছে। তোমার উপরও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এই বলে রান্না ঘরে গিয়ে ছুরি এনে আমার হাতে দিয়ে বলে- ‘তুমি ওকে খুন কর। ও আমাকে যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। তোমার কিছু হবে না”। এই বলে আমার সেই বান্ধবীটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ভাই তার আস্তে আস্তে বাসার থেকে বের হয়ে যায়।
আমি হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কিছু সময়। এটা কি করে হতে পারে? নিজের ভাই হয়ে এই সর্বনাশ করতে পারে? রিতাকে খুব অসুস্থ লাগলো। আমি তাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি, সমস্ত ঘটনার বিবরণ শুনি। রিতাকে আমি বুঝালাম বিষয়টা প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রিতা প্রথমে রাজী হতে চাইলো না। এটি প্রকাশ হলে সে সমাজচ্যুত হবে। ভাইটির ফাঁসি হবে।
রিতাকে আমি জানালাম- এটি কানাডা, তুমি আর পাকিস্তানে নও। মাথার থেকে এই সব চিন্তা দূর কর। তোমার কিছুই হবে না। তোমার ভাই যদি মানসিক রোগী হয় তাহলে তার চিকিৎসা হবে। এখানকার আইন অনেক মানবিক। আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার কোন ভয় নেই। লোকলজ্জার ভয়ে যদি গোপন কর তাহলে সে তো এই নির্যাতন চালিয়ে যাবে। রিতা রাজী হল। রিতা তার স্বামীকে সব জানাল। তিনিও আমার প্রস্তাবে রাজী হলেন। পুলিশকে সব জানানো হল, পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তার ভাইকে গ্রেফতার করলো। রিতাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলো। এটি শুধু শারীরিক চিকিৎসা না। মানসিকভাবে সে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারও চিকিৎসা চলতে থাকে। আমরা দুজনেই সাক্ষী দেই। এটি প্রাইভেট ব্যাপার হিসাবে সর্ব প্রকার গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। তাই এটি খবর হিসাবে সামনে প্রকাশ হতে পারে নাই। এটি ছিল আমাদের শর্ত।
পুলিশ কাস্টডিতে থাকাকালীন তার ভাইয়ের কিছু অস্বাভাবিক আচরণ ধরা পড়ে। পুলিশ তাকে হাসপাতালে পাঠায়। আশ্চর্যভাবে প্রমাণ হয় রিতার ভাইটি ভয়ানক এক মানসিক রোগে আক্রান্ত। এই রোগের নাম বাইপোলার ডিসঅর্ডার। এই ধরনের রোগীরা এক ধরনের হ্যালোসিনেসনের মধ্যে থাকে। রিলেশনের পার্থক্য ধরতে পারে না। ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। ঔষধের উপর নির্ভর করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় এসব রোগীকে।
দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তার ভাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কিন্তু রিতা আজও ঠিক হতে পারে নাই। সে কিছুতেই ভুলতে পারে নাই সেই ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। এখনও পুরুষ দেখলে ভয় পায়। চার বছরের মেয়েটিকে নিয়ে সব সময় দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে।
এই ঘটনার বিবরণ লেখার উদ্দেশ্য একটাই, সেটা হল- আমাদের সমাজেও ঠিক একই প্রকৃতির অসুস্থ লোক আছে, তা মনে করিয়ে দেয়া। যাদেরকে আমরা সুস্থ ভেবে নেই, এবং তাদের দ্বারা কৃত অপরাধগুলোকে কলঙ্ক ভেবে আমাদের অবলা নারীরা বুকের ভিতরে পাথর চাপা দিয়ে পরিবারের সম্মানটুকু রক্ষা করে।
জাত্যাভিমানী অনেক বাঙালী হয়তো আমার এই লেখা পড়ে বলবেন- তোমার এইসব কাণ্ড ইন্ডিয়া-পাকিস্তানে হয়, বাংলাদেশে এসব গজব নেই।
তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা- যে নাপাকী ভারতে আছে, পাকিস্তানে আছে তা এই বঙ্গ-বদ্বীপেও আছে। তাদেরও পায়ের সংখ্যা চার, আমাদেরও চার।
টমাস হবসের একটা কথা এখানে না বললেই নয়- ‘কোন শহর থেকে এক রাতের জন্যে আইন তুলে নিলে যে অবস্থা বিরাজ করে তাই স্টেট অফ নেচার’। মানুষ জন্মে পশু হয়ে, তাকে পরিশ্রম করে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। আর বদ লোকদের সামনে রেখেই আইন বানাতে হয়। আইন বানালেই শুধু হবে না, দেখতে হবে ধর্ম আর সংস্কৃতিতে অপরাধী কোন আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে কি না। যদি পেয়ে যায় তাহলে জালেমের থেকে মজলুমকে বেশী অপরাধী ভাববে সমাজ। এমন হলে দেখা যাবে ধর্ষিত হবার অপরাধে ধর্ষণের শিকারকে দোররা মারা হচ্ছে, অথবা দেখা যাবে কর্ণফুলী পাড়ের কোন এক দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে দেয়াল-লিখন- ‘গণধর্ষিতা জাহানারা ইমামের ফাঁসী চাই’। এসব অপবিস্তার ঠেকাতে সমাজ মেরামতের জন্য মেহনতের কোন বিকল্প নেই।