আমেরিকান জামাই চাই, ডিভোর্স চাই, সাংবাদিকও চাই!

নাহ্‌রীন খান: মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই বিয়ে করলেন শিল্পী আনুশেহ আনাদিল। পত্রিকার হেডিং “দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই বিয়ে করলেন আনুশেহ”। বিয়ের খবরটাতে সমস্যা ছিল না, তবে সাংবাদিক একটা “ই-প্রত্যয় “ দিয়ে অত্যন্ত সযত্নে বোঝাতে চাইলেন: “সন্তান নিয়ে তাও একটা নয়, দুই- দুইটা সন্তান নিয়ে বিয়ে! আনুশেহ তুমি পারো বটে” !!!

এই “ই প্রত্যয়টাই” কী বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয় যে, বাংলাদেশে আমরা মেয়েরা কোথায় আছি, কেমন আছি! এই সমাজ আমাদের “তালাকপ্রাপ্ত মাদার তেরেসা”  হিসেবে দেখতে চায়। বিয়ে ভাঙ্গামাত্রই এই সমাজ নানা উপমায় আমাদের উপমায়িত করবে। আমরা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে অচ্ছুৎ, সন্তানসহ বিয়ে করলে নির্লজ্জ, সন্তানকে রেখে বিয়ে করলে পাষাণ, বিয়ে না করে আবার কাউকে ভালবাসলে দ্বিচারিণী। আর আইন! সেতো তার পারিবারিক আদালত খুলেই রেখেছে এই একাকি মায়েদের সন্তানগুলোকে কেড়ে নেবার জন্য। আবার একই সমাজ দ্বিতীয়বার বিয়ে করা বাবাদের জন্য বানিয়ে রেখেছে “সমাজ বিনির্মিত” সান্ত্বনার বাণী –“ পুরুষমানুষ কী আর একা থাকতে পারে! আহা, বাচ্চাগুলোকে দেখার জন্য তো কাউকে লাগবে, নাকি !!!”

নাহরীন খান

এমনই “লৈঙ্গিক পক্ষপাতদুষ্ট বিবাহ -নির্ভর” দেশের  প্রধানমন্ত্রী-পুত্র আমেরিকাকে আইডল বানিয়ে বলেছেনঃ “আমেরিকায় কোন কোন জায়গায় মেয়েদের বিয়ের বয়স ১২। ওরা পারলে আমরা কেন পারবো না”? জুঁই আক্তারকে মনে পড়ে গেল। পড়াশুনা করতে চেয়েছিলে  বলে স্বামী তার হাতের আঙ্গুলই কেটে ফেলেছিল। আমেরিকায় কী পড়তে চাইলে  ১৭ বছরের জুঁইদের আঙ্গুল কাটে? আমেরিকাতে কি আদৌ জুঁইদের পড়ার জন্য স্বামীর অনুমতি লাগে? আমেরিকায় কি আনুশেহ’র আমেরিকান স্বামী নিউজ ফিডের কাটতি বাড়ায় দুই সন্তানের মাকে বিয়ে করার জন্য?

পুত্রের আমেরিকান আইডল থিয়োরিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবার একটু দেশীয় সংস্কৃতির আলোকে মডিফাই করেছেন। পশ্চিমে বাবার পরিচয় না থাকলেও শিশুর শিক্ষাগ্রহণে কোনো সমস্যা না হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “ওই দেশে বাবা-মা কে তা কেউ জানতে চাইবে না। কিন্তু আমাদের দেশে কী হবে?” বাংলাদেশে স্কুলে ভর্তির জন্য শিশুর বাবা-মা’র নাম উল্লেখ জরুরি বলে জানান তিনি। “বাবার নাম কী, মায়ের নাম কী, সমস্ত তথ্য দিতে হবে।  না দিলে কেউ ওকে গ্রহণ করবে না। ছেলে হোক, মেয়ে হোক তাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাকে কেউ চাকরিও দেবে না।“(বিডি নিউজ ২৪,ডিসেম্বর ১২, ২০১৬)।

ঠিক বলেছেন। বাবা যদি ধর্ষকও হয়, মাকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে বাবার নামকে বৈধ তো করতেই হবে। জৈবিক পিতা বলে কথা!!!  বিয়ের বয়স  যেমন তেমন,  বাবা খোঁজ করুক আর না করুক, সন্তানের বাবার নাম লিখতেই হবে। বিয়ের বয়সে আমেরিকা আমাদের আইডল কিন্তু বাবার নাম লেখাতে আমরা সেই রক্ষণশীল বাঙালি ।

বিয়ের বয়স আমাদের আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিয়ে, আর ডিভোর্স আমাদের খুবই রেখে ঢেকে, মুসলিম পারিবারিক আইন মেনে। তালাক বলার তিন মাসেই ডিভোর্স, কাবিনের টাকা পরিশোধ না করবার বাহানা, আর সন্তানের ভরণপোষণ দেবার বেলায় বাবার নিজেকে আদালতে কপর্দকশূণ্য প্রমাণ করার যে খেলা শুরু হয়, তাতো কোনো আমেরিকানকে দেখতে হয় বলে জানা নেই। আমেরিকায় ডিভোর্সের সাথে সাথে যা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে, তা দুই ভাগ হবে, সন্তানের ভরণপোষণ দিতেই হবে, না দিলে চাকরিও চলে যেতে পারে, আর প্রাক্তন স্ত্রীকেও দিতে হয় তার প্রাপ্য সম্মান ।

তাই বলছি, আমেরিকার কিছু নেবেন আর কিছু নেবেন না, তা কী করে হয়!

চলুন দেশটাকে আস্ত একটা আমেরিকা বানাই। দেন আমাদের বিয়ে, ১২, ১৬ , ১৮ বা ৬৮ তে (আমেরিকাতে এই বয়সেও প্রচুর বিয়ে হয়)। আমেরিকান শাশুড়ি দেন, যে কিনা কালো বলে খোঁটা দেবে না, পাতে এঁটো খাবার তুলে দেবে না। একেকটা আমেরিকান জামাই দেন, যে কিনা পড়াশুনা করতে চাইলে হাত কেটে দিবে না, যৌতুক নিবে না।

আমেরিকান ডিভোর্স দেন, যাতে সম্পত্তির সমান ভাগবাটোয়ারা হয়, পুরানো সন্তান, নতুন সন্তানের মতই সমান অধিকার পায়। আর শেষমেশ আমেরিকান একটা সাংবাদিক দেন, যাতে আনুশেহদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা আর অধিকার খবরের কাগজের কাটতি না বাড়ায়।

সবাই এগোয়,  সবই  এগোয়, প্রবৃদ্ধি এগোয়, সুচক এগোয়, বিয়ের বয়সও এগোয়, কেবল “নারী আর নারীর সম্মান” পেছায় আর পেছায়।

লেখক: শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.